মহান ভাষার মাস
একুশের চেতনা অন্যায় ও বৈষম্য প্রতিরোধের প্রেরণা

অধ্যাপক ড. এএম সরওয়ারউদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

একুশের চেতনা বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন কেবল মাতৃভাষার অধিকারের জন্য সংগ্রাম ছিল না, বরং এটি ছিল স্বাধীনতার পথচলার প্রথম সোপান। ভাষার জন্য জীবন দেওয়া শহিদদের আত্মত্যাগ পরবর্তী সময়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছে, যা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে গতি সঞ্চার করে। একুশের চেতনা আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, ন্যায়বিচার ও সম-অধিকারের ভিত্তি রচনা করেছে। সর্বশেষ ২০২৪-এর জুলাইয়ে সংঘটিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান একুশের সেই চেতনাকে নতুনভাবে সামনে নিয়ে এসেছে।
২০২৪ সালের ৫ জুন, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর জারি করা চাকরির ক্ষেত্রে কোটা বাতিলের পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণা করে। এর ফলে পুনরায় কোটাপ্রথা চালু হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষের জন্ম দেয়। শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে রাজপথে নামে এবং এ আন্দোলন দ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে আন্দোলন দমন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থান নেয়, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন শুধু কোটা সংস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি সরকারব্যবস্থার স্বচ্ছতা, ন্যায়বিচার ও সমানাধিকারের দাবিতে পরিণত হয়। আন্দোলন দমনে সরকার কঠোর নীতির আশ্রয় নিলে সাধারণ জনগণও শিক্ষার্থীদের পাশে এসে দাঁড়ায়। ক্রমে এটি সরকারবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে রূপ নেয়, যেখানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সংহতি প্রকাশ করে।
একুশের চেতনা আমাদের শিখিয়েছে, অধিকার আদায়ে জনগণের ঐক্যই মূল শক্তি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যেমন তরুণরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল, তেমনই ২০২৪-এর জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানেও ছাত্রসমাজ ছিল নেতৃত্বে। এ আন্দোলন প্রমাণ করে যে, ইতিহাসের যে কোনো সংকটময় মুহূর্তে তরুণরাই পরিবর্তনের পথ দেখায়।
জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং ভারতে আশ্রয় নেন। পরবর্তী সময়ে শান্তিপূর্ণ উত্তরণের লক্ষ্যে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। এই রাজনৈতিক পরিবর্তন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে, যা একুশের চেতনার উত্তরাধিকার বহন করে।
একুশের চেতনা শুধু অতীতের ঘটনা নয়, এটি আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের পথনির্দেশক। একুশ আমাদের শিখিয়েছে, যে কোনো অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলাই জাতীয় মুক্তির পথ। একুশের শিক্ষা হলো গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের প্রতি অবিচল থাকা।
২০২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান একুশের চেতনাকে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে। এ গণ-অভ্যুত্থান প্রমাণ করেছে যে, জনগণের ঐক্য ও সংগ্রামই সত্যিকার পরিবর্তন আনতে পারে। বাঙালি জাতি কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না। তাই একুশের চেতনাকে বুকে ধারণ করে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে, যাতে ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অব্যাহত থাকে।
অধ্যাপক ড. এএম সরওয়ারউদ্দিন চৌধুরী : উপাচার্য, হযরত শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট