Logo
Logo
×

শেষ পাতা

মহান ভাষার মাস

চেতনা শব্দটির বারোটা কারা বাজিয়েছেন?

Icon

আন্দালিব রাশদী

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

চেতনা শব্দটির বারোটা কারা বাজিয়েছেন?

দীর্ঘসময় ধরে সংঘবদ্ধ ধর্ষণে অংশগ্রহণকারীরাও ধর্ষণকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে সাফাই গেয়েছেন। ‘চেতনা’ শব্দটির ব্যবহার আমি প্রায় ছেড়েই দিয়েছি। চেতনা উচ্চারণ করলেই মনে হয়, এই বুঝি মিথ্যের এক বেসাতি শুরু হতে যাচ্ছে।

এদেশে এমনকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে লাগাতার মিথ্যা বর্ষণের আগে জাতীয় সংগীতও বাজানো হয়েছে।

‘চেতনা’র বিরামহীন অপব্যবহারে এটি একটি বাজে বমনোদ্রেককর শব্দ হিসাবে আমার ব্যক্তিগত অভিধানের পরিত্যাজ্য শব্দের তালিকার শীর্ষস্থানে অবস্থান করছে। কিন্তু এত শব্দ থাকতে চেতনারই কেন এমন পরিণতি হবে? যারা এর উত্তর দেবেন, তারা ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়েছেন; যারা পালাতে পারেননি, রং বদলেছেন কিংবা গর্তজীবী হয়েছেন। স্বর উঁচু করতে পারলে বলতেন, আরে এটাই তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

চেতনার অনুষঙ্গ মুক্তিযুদ্ধ। ‘চেতনাজীবীরা’ একদা পরম আদৃত শব্দটির দ্যুতি হরণ করতে যেসব কাজকে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাপ্রসূত’ বলে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, আমি তার একশত একটির এক তালিকা প্রণয়ন করেছি। কেবল আমি নই, যে কোনো হরফজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ এ তালিকা তৈরি করতে পারতেন।

তালিকা প্রণয়নে আমার কোনো মৌলিকত্ব নেই-তারা, মানে যারা চেতনা ভাঙিয়ে জীবনধারণ করেন, তারা একের পর এক কাজগুলো করে গেছেন, আমি আমার বিগত দিনের স্মৃতি থেকে তুলে এনে কোনো ধরনের অগ্রাধিকারক্রম অনুসরণ না করে লিখে গেছি। এমনই চেতনাস্পৃষ্ট শত কর্মতালিকার একটি অংশ কেবল প্রকাশ করছি :

১. চেতনা-প্রণোদনায় এমনকি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেও তারা ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এর পর থেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে অবিরাম মিথ্যাচার চালিয়ে কৃষ্ণবর্ণ জহর কোট গায়ে চাপিয়ে, রাইফেলের ট্রিগারে হাত রেখে ছবি তুলে অচিরেই কিছু পয়সা খরচ করে মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সার্টিফিকেট জোগাড় করেছেন। এই সার্টিফিকেট ভাঙিয়ে তারা যা আদায় করেছেন, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তা স্বপ্নেও দেখেননি। চেতনা বাণিজ্যের শুরু তাদেরই হাতে।

২. মুক্তিযুদ্ধের চেতনাস্নাত হয়ে বাড়িঘর, দোকানপাট, হাটবাজার, প্রথম দফায় লুটতরাজ এবং দ্বিতীয় দফায় দখল সম্পন্ন করেছেন। এসব জায়েজ করার জন্য মাতৃপতি বিস্মৃত হয়ে নব্যপিতা সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করেছেন।

৩. ‘মুক্তিযোদ্ধার চেতনা’ ভাঙিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী ট্যাগ লাগিয়ে সেই সব দখলকৃত বাড়ির নয় থেকে নব্বই বছর বয়সি নারীকে ধর্ষণ করে স্বাধীনতার আস্বাদ লাভ করেছেন।

৪. চেতনাচালিত হয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রকে গণশোষণের হাতিয়ারে পরিণত করেছেন। রাষ্ট্র যদি খুন-ধর্ষণে সহায়তাই না করে, তবে কীসের জন্য এই স্বাধীনতা!

৫. মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে শাসনতন্ত্র থেকে সুশাসন উঠিয়ে দুঃশাসনকে গণনিয়তি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন।

৬. চেতনার বলে বলীয়ান হয়ে শিক্ষাঙ্গনকে দানব সৃষ্টির কারখানায় পরিণত করেছেন। শত খুন ও শত ধর্ষণের সেঞ্চুরিয়ানও জাতীয়ভাবে উদ্যাপিত হয়েছেন।

৭. চেতনার দোহাই দিয়ে স্বৈরশাসনের ভিত্তিপ্রস্তর পোক্ত করতে বাড়তি চেতনার সিমেন্ট লাগিয়েছেন।

৮. চেতনাধারায় অবগাহন করিয়ে উঞ্ছজীবী আবর্জনা প্রজননকারী একটি লেখকগোষ্ঠী তৈরি করেছেন, শিল্পী গোষ্ঠীও। তারা লেহ্যচুষ্যপেয় হিসাবে নেতানেত্রীর বর্জ্যও সাদরে থালায় তুলে নিয়েছেন।

৯. চেতনাপন্থিরা হাঁটুতে ভর দিয়ে হাঁটা একটি প্রতিবন্ধী প্রজন্ম সৃষ্টি করেছেন। তারা চেতনার প্রজন্ম।

১০. চেতনাজনক, চেতনাজননী, চেতনাভ্রাতা, চেতনাভগ্নী, চেতনামামা, চেতনামামি আত্মীয়তার জাল বুনে লুণ্ঠনপ্রিয় একটি ভিআইপি জনশ্রেণি তৈরি করেছেন।

১১. ‘চেতনা চেতনা’ শোর তুলে জাতির কান স্তব্ধ করে, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিশ্চল করে দিয়ে একটি খোজা জনগোষ্ঠী তারা পয়দা করেছেন।

১২. আমরা না মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, আমরা না ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার বংশধর-এমন কয়েকটি প্রজন্ম চেতনার দোহাই দিয়ে পরীক্ষায় নকল করে পাশ করানোর বাধ্যবাধকতা চেয়েছে, কর্মের নিশ্চয়তা চেয়েছে, ঠিকাদারির কমিশনের নিশ্চয়তা চেয়েছে, ক্ষমতার ভাগ চেয়েছে এবং পেয়েছে।

১৩. চেতনামাদকে আকণ্ঠ ডুবে অবিরাম মিথ্যাচার চালিয়ে সত্যকে হত্যা করেছেন, অসুরপূজা করেছেন, দেশকে পিতার ও পিতামহের তালুকে পরিণত করেছেন।

১৪. চেতনামদির উন্মত্ততায় গণতন্ত্রকে ঠাট্টা-তামাশার হাতিয়ারে পরিণত করে প্রহসনের নির্বাচন দেখিয়ে ক্ষমতার মসনদ অধিকার অব্যাহত রেখেছেন।

১৫. চেতনাসমৃদ্ধি অর্জনে স্থানে স্থানে, ভবনে ভবনে, আয়নাঘরে, গুমঘরে বিরুদ্ধস্বর স্তব্ধ করেছেন।

এসব কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হতে পারে? মাত্র ছ মাস আগে পালিয়ে যাওয়া সেসব চেতনাবাজ নাকি আবার সেপটিক ট্যাংকের ভেতর থেকে কচ্ছপমুণ্ডু বের করে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে! কতকিছুই তো ঘটতে পারে।

কিন্তু ভাষার মাসে এসবকে যে আমি একুশের চেতনা বলে চালিয়ে দিতে পারছি না। যারা চেতনা শব্দটিকে কলুষিত ও পরিত্যাজ্য করে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন-একটি শব্দ হত্যার অপরাধে তাদের ওপর ঘৃণাবর্ষণ অব্যাহত থাকুক।

আন্দালিব রাশদী : লেখক, ঔপন্যাসিক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম