মহান ভাষার মাস
বইমেলা হোক সারা দেশে

আতাহার খান
প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

‘একুশের বইমেলা আমাদের কাছে একটা প্রাণোৎসবের মেলা। বইকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষ, লেখক, পাঠক, প্রকাশকসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য এই মেলা যেন একটা অভয়াঙ্গন। একেবারে শুরুতে কিন্তু বইমেলাটি আজকের মতো এমন জাঁকজমকপূর্ণ ছিল না। বরং বলা যায়, খুব হতশ্রী অবস্থার মধ্য দিয়েই এর পথচলা শুরু। স্বাধীনতার পর বাংলা একডেমির নানা একুশের অনুষ্ঠানের পাশে সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালে চাদরের ওপর বই সাজিয়ে বিক্রি শুরু করেন শিল্পপতি আমান সাহেবের শ্বশুর তাজুল ইসলাম, যার বাংলাবাজারে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ছিল। এই ব্যতিক্রমধর্মী পদক্ষেপটি সৃজনশীল প্রকাশনার অন্যতম পথিকৃৎ ‘মুক্তধারা’র স্বত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহাকে অনুপ্রাণিত করে এবং মূলত তিনিই ১৯৭৩ সাল থেকে বই মার্কেটিংয়ের সেই হতশ্রী রূপ পালটিয়ে শ্রী ফিরিয়ে আনেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি একাই ভাষা শহিদের মাস ফেব্রুয়ারিজুড়ে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বই বিপণনের এই উদ্যোগকে জিইয়ে রাখেন। ১৯৭৬ সাল তার দেখাদেখি দেশের অন্যান্য উৎসাহী প্রকাশকরাও বইমেলার সঙ্গে শরিক হন। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমিকে এই বইমেলার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। কালক্রমে প্রকাশক-বাংলা একাডেমি মিলে একে একটা সুন্দর রূপ দেন। প্রথমে একাডেমি চত্বরের কিছুটা অংশে, পরবর্তীতে একাডেমিজুড়ে আর এখন তো সেই পরিসর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।
২.
‘বইমেলা’ বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতকে শক্ত ভিত্তি গড়ে তোলার সুযোগ করে দিয়েছে। এক্ষেত্রে মৌলিক ও মননশীল লেখকদের অবদান চিরনমস্য।
আমরা একজন অসাধারণ স্বনামধন্য জনপ্রিয় লেখককে পেয়েছিলাম, তিনি হলেন হুমায়ূন আহমেদ। ‘বাংলাদেশের প্রকাশনা’কে ‘শিল্প’ হিসাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার মতো লেখকের অবদান যদি বলি প্রায় অর্ধেকের বেশি, তবে আমার এই ধারণাকে নিশ্চয়ই ভুল বলা যাবে না।
৩.
বইমেলা আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চেতনাকে সংহত করছে। এই মেলা দেশের জন্য পরিণত হয়েছে সোশ্যাল ক্যাপিটালে। এটা একটা বিরাট ব্যাপার, বিষয়টা আমাদের সবার অজান্তে, অগোচরেই ঘটছে, ঘটে চলেছে। আমার মনে হয়, বিষয়টা আয়োজক-প্রকাশক, লেখক-পাঠক সবারই বোঝার চেষ্টা করা প্রয়োজন। এই বিষয়টি না বোঝার কারণে বইমেলাকে কেন্দ্র করে নানা নেতিবাচক ঘটনা ঘটে। বইমেলাকে ইতিবাচক করে তুলতে হলে লেখক-প্রকাশক-পাঠকদের মধ্যে মতবিনিময়, ভাবনার আদান-প্রদানের উদ্যোগ নিতে হবে। এখানে বাংলা একাডেমি এবং প্রকাশকদের একমত হওয়া দরকার। প্রকাশকদেরও অপেশাদার মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। লেখক যাতে তার রয়্যালিটির টাকা ঠিকমতো পান সে ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বইয়ের দাম পাঠকের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখতে হবে। বিলাসী পণ্য করে তোলা যাবে না একে। তবে বই ছাপা ও বাঁধাইয়ের ক্ষেত্রে আরও যত্নশীল হওয়া দরকার। এজন্য করণীয়ও ঠিক করা প্রয়োজন।
৪.
বইমেলার সবচেয়ে নেতিবাচক দিক হচ্ছে ‘অসম্পাদিত’ বই প্রকাশ। এটা একটা বিকশিত শিল্পের মৃত্যু ঘটানোর সর্বনাশা খেলা। প্রকাশনা সংস্থাগুলোকে মানসম্মত বই প্রকাশের জন্য অবশ্যই ‘সম্পাদনা পরিষদ’ রাখা বাধ্যতামূলক। এখানে অমনোযোগী হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যাচাই-বাছাই করে মানসম্মত বই মেলায় আনা চাই। এটা করা এখন সময়ের দাবি। যেসব প্রকাশকের ‘সম্পাদনা পরিষদ’ নেই, তার মানে বই ‘সম্পাদনা পরিষদ’ কর্তৃক সম্পাদিত নয়, সেসব বই প্রকাশ করা যাবে না। এ জন্য চাই কড়া নিয়মকানুন। প্রকাশনা শিল্পের বৃহত্তর স্বার্থেই এটি করা অত্যন্ত জরুরি।
৫.
বইয়ের মার্কেটিং আরেকটি জরুরি বিষয়। প্রযুক্তির কল্যাণে কাগজে ছাপা বই এখন একটা সংকটের সম্মুখীন। তাই মার্কেটিংয়ের জন্য প্রকাশকরা দেশব্যাপী বইমেলার আয়োজন করতে পারেন। সেখানে রাখা চাই স্থানীয় উপজেলা, জেলা এবং বিভাগীয় প্রশাসনের সহযোগিতা।
৬.
বইমেলাকে দলীয় রাজনীতি কিংবা সরকারি খবরদারির বাইরে রাখতে হলে বইমেলা উদ্বোধন করা উচিত সর্বজন শ্রদ্ধেয় লেখক, বিশ্বাবিদ্যালয়ের উপাচার্য, সমাজে সমাদৃত ব্যক্তিকে দিয়ে। সেখানে আমরা দেখি, বইমেলার উদ্বোধন করা হয় সরকার প্রধানকে দিয়ে। গত সরকারের আমলে আমরা দেখিছি বইমেলার স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ ও চেতনা কীভাবে অসার করে দেওয়া হয়েছিল। বইমেলা দলাদলি-ঠেলাঠেলির ঊর্ধ্বে থাকলে আমরা সবাই উপকৃত হব। বইমেলায় ব্যক্তিপূজা, ব্যক্তিবন্দনা নয়, বইমেলা হবে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সম্মিলনের স্থান। তাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা এবং আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ব্যক্ত করার অভয়াঙ্গন।
৭.
বইমেলার সঙ্গে আমাদের ভাষাশহিদের চেতনা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। ভাষাশহিদদের চেতনার অন্যতম নির্যাস হচ্ছে সমাজের সবার মানে সামষ্টিক অধিকার প্রতিষ্ঠার চেতনা। সামষ্টিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব। বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য সারা দেশে বইমেলাকে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
আতাহার খান : কবি, সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা