টেকসই পোশাকের জন্য দরকার যৌথ অংশীদারত্ব

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
-67abc210eb3ee.jpg)
ছবি: সংগৃহীত
শুধু গার্মেন্ট মালিকদের একক প্রচেষ্টায় পোশাক উৎপাদন টেকসই করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে বিদেশি ক্রেতাদেরও ভূমিকা আছে। বিদেশি ক্রেতাদেরও পোশাকের উপযুক্ত দাম নিশ্চিতের মাধ্যমে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। পাশাপাশি জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি, পানির ব্যবহার হ্রাস এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ আমদানিতে সরকারকে নীতি সহায়তা দিতে হবে।
মঙ্গলবার রাজধানীর একটি হোটেলে সাসটেইনেবল অ্যাপারেল ফোরামের ষষ্ঠ সংস্করণে অংশ নিয়ে বক্তারা এসব কথা বলেছেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিবেশ, বন, জলবায়ু পরিবর্তন ও পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান মাইকেল মিলার, বাংলাদেশে নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত এইচ. ই. আন্দ্রে কার্স্টেন্স, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, শুধু সবুজ কারখানা বা সর্বোচ্চ পরিবেশবান্ধব কারখানার সংখ্যা থাকার অর্থ এই নয় যে, শিল্প খাত টেকসইভাবে পরিচালিত হচ্ছে। পোশাক শিল্প জ্বালানিনির্ভর, পানি নির্ভর এবং রাসায়নিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সংবেদনশীল, তাই দায়িত্বশীল উৎপাদন ব্যবস্থায় এসব নিশ্চিত করতেই হবে। তাছাড়া টেকসই পোশাক খাতের জন্য শ্রমিকের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রে ‘সস্তা শ্রম’ শব্দটি আমাদের শব্দভাণ্ডার থেকে মুছে ফেলা উচিত। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে উৎপাদক ও ভোক্তা-উভয়কেই সমান দায়িত্ব নিতে হবে। এ জন্য ক্রেতারা নৈতিকভাবে সোর্সিং ও ন্যায়সঙ্গত ব্যবসা পরিচালনার আহ্বান জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ পানিসমৃদ্ধ দেশ হলেও শিল্পাঞ্চলগুলোতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে, যা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ কারণে সরকার শিল্প খাতে পানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে চার্জ আরোপের পরিকল্পনা করছে এবং পানি পুনঃব্যবহারের জন্য বিশেষ প্রণোদনা দেওয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে চৌধুরী আশিক বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রয়োজন নেই। অন্তর্বর্তী সরকার ৫টি অর্থনৈতিক অঞ্চল পূর্ণাঙ্গরূপে চালুর চেষ্টা করছে। বাকি ৯৫টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের জায়গায় সোলার পাওয়ার স্থাপন করা যায় কিনা তার সম্ভাব্যতা যাচাই করার জন্য ব্যাংকসহ অন্য সংস্থার সঙ্গে পরামর্শ করছে। এছাড়া বাংলাদেশের ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নে বিডার ওয়েবসাইটে লাইভ ডাটা শেয়ার করা হচ্ছে। কোন সংস্থা কত দিনে সনদ প্রদান করবে, সেটির সময় দেওয়া থাকছে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেটি মনিটর করা হচ্ছে। আগামী ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে ব্যবসা পরিবেশের দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যাবে।
নেদারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত এইচ. ই. আন্দ্রে কারস্টেন্স বলেন, ইউরোপের তরুণ ক্রেতারা পোশাক পরিধানের ক্ষেত্রে নৈতিক ও পরিবেশবান্ধব উৎপাদনকে গুরুত্ব দেয়। তারা জানতে চায়, উৎপাদনের সময় এসব বিষয় বিবেচনা করা হয়েছে কিনা? তিনি আরও বলেন, নেদারল্যান্ডস বাংলাদেশের সঙ্গে এর অংশীদরিত্বকে এবং বিশ্বের পোশাক শিল্পে তার নেতৃস্থানীয় ভূমিকাকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে। বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় একত্রে কাজ করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা পোশাকের ভ্যালু চেইনের প্রধান অংশীদারদের একত্রিত করেছি, কারণ বাংলাদেশকে একটি দায়িত্বশীল সোর্সিং গন্তব্য হিসাবে তার অবস্থান সুদৃঢ় করতে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য।
সাসটেইনেবল অ্যাপারেল ফোরামে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানসহ ৪টি প্যানেল আলোচনা, টেকসই পোশাক খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পৃথক বিষয়ের ৫টি উপস্থাপনা এবং দুটি ব্রেক আউট সেশন অনুষ্ঠিত হয়। ফোরামে ২০ জনেরও বেশি উদ্ভাবক এবং ৪০ জনেরও বেশি বিশ্বমানের আলোচকসহ ৫৫০ জনের অধিক দেশি-বিদেশি অতিথি অংশগ্রহণ করেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর ‘বাংলাদেশ ২০৪০ : স্থিতিস্থাপক ও টেকসই পোশাক খাতের রোডম্যাপ’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন বিটিএমএ’র সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল, বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আনোয়ার উল আলম পারভেজ ও বিজিএমইএ’র সাবেক জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি আব্দুল্লাহ হিল রাকিব, রাইজিং গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ হাসান খান এবং কেডিএস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম রহমান।
আনোয়ার উল আলম বলেন, এলডিসি উত্তরণ এড়ানো যাবে না। তবে অর্থনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এটি ৩ বছর পিছিয়ে দেওয়া উচিত। কারণ উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অর্থনীতি এখনো প্রস্তুত নয়। করোনা পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং সর্বশেষ গত বছরের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে কঠিন সময়ে এসে দাঁড় করিয়েছে। পক্ষান্তরে প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে ভিয়েতনাম ২০২৭ সাল পর্যন্ত শূন্য শুল্ক সুবিধা ভোগ করবে। এমন প্রেক্ষাপটে জিএসপি প্লাস সুবিধা না পাওয়া পর্যন্ত এলডিসি উত্তরণ পেছানো দরকার।
শওকত আজিজ রাসেল বলেন, বিশ্ব বাজারে তৈরি পোশাকের ৭০ ভাগ ম্যানমেড আর্টিফিসিয়াল ফাইবার, সিনথেটিক ফাইবার দখল করে আছে। বাকি ৩০ ভাগ কটন প্রোডাক্টের। বাংলাদেশ ৭০ ভাগের বাজার ধরতে পারছে না শুধু সরকারের নীতি সহায়তার অভাবে। সিনথেটিক ফাইবারের প্রধান উপকরণ পেট চিপস। কিন্তু বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে পুরাতন বোতল আমদানি বন্ধ রয়েছে। এ নিয়ে উপদেষ্টাদের সঙ্গে বার বার দেখা করতে চেয়েও পারিনি। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে সরকার কীভাবে রপ্তানিকে প্রমোট করবে।