গভর্নরের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বৈঠক
ঋণের সুদ কমিয়ে সিঙ্গেল ডিজিটে আনার সুপারিশ
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ব্যাংক ঋণের সুদহার পর্যায়ক্রমে কমিয়ে সিঙ্গেল ডিজিটে আনার সুপারিশ করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে ঋণের সুদহার আর বাড়ানো যাবে না। একই সঙ্গে অনিচ্ছাকৃত খেলাপিদের ঋণ নবায়নের ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় দিয়ে নীতিমালা করার প্রস্তাব দিয়েছেন তারা। পাশাপাশি খেলাপি ঋণের বিদ্যমান সংজ্ঞা আরও শিথিল, ডলারের জোগান স্বাভাবিক এবং দাম স্থিতিশীল রাখার কথা বলেছেন। বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ ১ শতাংশ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণ ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে নবায়ন এবং এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১২ বছরে পরিশোধের সুযোগ দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। ডলার সংকট ও বিনিময় হারের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধে বিশেষ সুবিধা এবং একক গ্রাহকের ঋণসীমা বৃদ্ধির প্রস্তাব দেওয়া হয়।
রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) প্রতিনিধিদলের মতবিনিময় সভায় এসব প্রস্তাব দেওয়া হয়। সংগঠনটির প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলে আরও উপস্থিত ছিলন এফবিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, সাবেক সহসভাপতি আবুল কাশেম হায়দার, সাবেক পরিচালক আব্দুল হক, গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী (খোকন), প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী (সিইও) আহসান খান চৌধুরী, বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি এসএম ফজলুল হক, এফবিসিসিআই-এর মহাসচিব মো. আলমগীর, সাধারণ পরিষদ সদস্য জাকির হোসেন নয়ন ও মো. জাকির হোসেন। বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংক খাত স্থিতিশীল রাখতে বহুমুখী সংস্কার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে ব্যবসায়ীরা সুফল পাবেন। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি কমানোর জন্য সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। এ হার ইতোমধ্যে কমতে শুরু করেছে। আরও কিছুটা কমে গেলে পর্যায়ক্রমে ঋণের সুদের হার কমানো হবে। তিনি আরও বলেন, ব্যবসায়ীদের স্বস্তি দিতে ব্যাংক খাতে আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে। অর্থনীতির টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে ব্যবসায়ীদের সমর্থন ও সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।
বৈঠকে ব্যবসায়ীরা বলেন, বর্তমান বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশি পণ্যের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখতে বিনিয়োগের স্বার্থে এবং মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে সুদের হার স্থিতিশীল রাখতে হবে। এ হার আর বাড়ানো ঠিক হবে না। সুদের হার ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনা জরুরি। বিভিন্ন খাতে নীতিসহায়তা প্রদানের মাধ্যমে সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিট নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে বিশেষ জোর দেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলেন, সুদের হারসহ অন্যান্য উপকরণের দাম বৃদ্ধির কারণে ব্যবসায় খরচ বেড়ে গেছে।
ব্যবসায়ীরা বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অনেক উদ্যোক্তা ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা হারিয়েছেন। ফলে তারা খেলাপি হয়ে পড়ছেন। যারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি নন, তাদের ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণ নবায়নে বিশেষ ছাড় দিতে হবে। এক্ষেত্রে বড় শিল্পের ক্ষেত্রে খেলাপি কিস্তি বা খেলাপি দায় স্থিতির ১ শতাংশ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণগ্রহীতাদের জন্য ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ নবায়নের সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করেন। এক্ষেত্রে ঋণের কিস্তি পরিশোধে গ্রেস পিরিয়ড দিতে হবে এক বছর। ১২ বছর মেয়াদে নবায়ন করা ঋণ পরিশোধের সুযোগ দিতে হবে।
ব্যবসায়ীরা বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পকারখানাকে নীতিসহায়তা প্রদান, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়জনিত ক্ষতি মোকাবিলায় উদ্যোক্তাদের সহায়তা, সময়মতো রপ্তানি বিল পরিশোধ, এসএমই এবং কৃষি খাতের জন্য বিশেষ ঋণ সুবিধা সম্প্রসারণসহ দেশে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আরও শিথিল করার প্রস্তাব দেন তারা। বর্তমানে অপরিশোধিত ঋণের কিস্তি যে তারিখে পরিশোধের জন্য নির্ধারিত থাকবে, সে তারিখ থেকে পরবর্তী ছয় মাস অতিক্রম হওয়ার পর মেয়াদোত্তীর্ণ হচ্ছে। এ সময়সীমা আরও বাড়িয়ে নয় মাস করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বৈঠকে বলা হয়, আমদানি-রপ্তানি উৎপাদন কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্ন রাখার স্বার্থে বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার জোগান স্বাভাবিক রাখার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে হবে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পকারখানা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রয়োজনীয় নীতিসহায়তা প্রদানের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
বৈঠকে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, কয়েক বছর ধরে ডলারের দাম বাড়ছে। ডলার সংকট ও ডলারের বিনিময় হারের কারণে যেসব ব্যবসায়ী ক্ষতির মুখে পড়েছেন, তাদের বিশেষ সহায়তা দিতে হবে। এ খাতের উদ্যোক্তাদের নিয়মিত ব্যাংক ঋণের বাইরে একটি হিসাব খুলে ২ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১৫ বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধের সুযোগ প্রদানের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
বর্তমানে শিল্পের কাঁচামাল ও ব্যবসার খরচ বৃদ্ধির কারণে উদ্যোক্তাদের ঋণসীমা বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়। বর্তমানে উদ্যোক্তারা কোনো ব্যাংকের মূলধনের সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ ঋণ নিতে পারেন। বর্তমানে খেলাপি ঋণ বাড়ায় অনেক ব্যাংকের মূলধন কমে গেছে। ফলে ব্যাংকগুলোর পক্ষে কোনো একক গ্রাহককে দেওয়া ঋণসীমাও কমে গেছে। এতে উদ্যোক্তারা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে চাহিদা অনুযায়ী ঋণ পাচ্ছেন না। এ কারণে একক ঋণসীমা বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করেন ব্যবসায়ীরা।
বৈঠকে এসএমই ও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংকিং সুবিধা সম্প্রসারণের কথা বলা হয়েছে। এ লক্ষ্যে ব্যাংকের সব শাখায় নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তার জন্য হেল্পডেস্ক কার্যকর করা এবং সহজ শর্তে জামানতহীন ঋণের সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। একই সঙ্গে কৃষি খাতে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে এ খাতে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ ৫ শতাংশ সুদে বিতরণের প্রস্তাব করা হয়।