Logo
Logo
×

শেষ পাতা

একান্ত সাক্ষাৎকারে ডিএমপি কমিশনার

পুলিশের কেউ অপরাধ করে পার পাবেন না

Icon

সিরাজুল ইসলাম

প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পুলিশের কেউ অপরাধ করে পার পাবেন না

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী বলেছেন, কোনো পুলিশ সদস্য অপরাধ করে পার পাবেন না। তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা। ইতোমধ্যেই এ ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে। বাহিনীর ভেতরে শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে ডিএমপির অবস্থান জিরো টলারেন্স (শূন্য সহিষ্ণু) নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। রোববার নিজ অফিস কক্ষে যুগান্তরকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে যেসব পুলিশ সদস্য ঢাকায় চাকরি করেছেন তাদের কেউই ডিএমপিতে থাকতে পারবেন না। ইতোমধ্যেই তাদের বের করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া পুলিশের অপকর্ম, ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে ভুয়া মামলা, থানায় সেবা, ছিনতাই, চাঁদাবাজি এবং ডাকাতিসহ রাজধানীর সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সমসাময়িক ইস্যু নিয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর দেন শেখ সাজ্জাত আলী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন যুগান্তরের বিশেষ প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম

শেখ সাজ্জাত আলী বলেন, কেউ খারাপ কাজ করলে যেমন ফল ভোগ করবেন, তেমনি ভালো কাজ করলে পুরস্কার পাবেন। নিজের জীবন বাজি রেখে সম্প্রতি যে এএসআই চাঁদাবাজকে গ্রেফতার করেছেন, তাকে শিগগিরই বিপিএম (বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল) পদক দেওয়া হবে। ছিনতাইকারী ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটকে মাঠে নামানো হয়েছে জানিয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, এখন থেকে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হলে ১ ঘণ্টার মধ্যেই অ্যাকশনে যাবে পুলিশ। এছাড়া থানায় সেবার মান বাড়ানোর জন্য এবং যে কোনো জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে গঠন করা হবে সিটিজেন ফোরাম। সব সমস্যা সমাধানের জন্য রাজপথকে বেছে না নিয়ে আলোচনার টেবিলে বসে সমস্যার সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন শেখ সাজ্জাত আলী।

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর অনেক মামলা হয়েছে, যেগুলোতে ভুয়া আসামির ছড়াছড়ি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার বলেন, আমরা তাদের গ্রেফতার করব না। যাদের বিরুদ্ধে অপরাধের তথ্য-প্রমাণ মিলবে না তাদের ভয়ের কিছু নেই। এ সংক্রান্ত মামলাগুলো রিভাইজ করা হচ্ছে। যারা প্রকৃত অপরাধী এজাহারে শুধু তাদের নামই থাকবে। গণহারে দেড়শ-দুইশ আসামির মামলা থাকবে না। ঘটনার সময় দেশেই ছিলেন না তাদেরও মামলায় আসামি করা হয়েছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না।

কমিশনার বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বা জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর নানা কারণে পুলিশ প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুলিশ সদস্যরা ট্রমার মধ্যে পড়ে যান। গত ৫-৬ মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে পুলিশকে ট্রমা অবস্থা থেকে বের করে আনতে সক্ষম হয়েছি। এখন পুলিশ সদস্যরা মনোবল ফিরে পেয়েছেন। পুলিশের নির্লিপ্ততার কারণে গণ-অভ্যুত্থানের পরপরই ঢাকায় ব্যাপক লুটতরাজ, ডাকাতি, ছিনতাই হচ্ছিল। এখন আর সেই অবস্থা নেই।

চাঁদাবাজ ও ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে ডিএমপির প্রধান পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, গত ১৫ দিন ধরে চাঁদাবাজ ও ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযান চালিয়েছি। বহু ছিনতাইকারী-চাঁদাবাজকে হাতেনাতে গ্রেফতার করেছি। ব্লক রেইড করেও তাদের ধরেছি। শনিবারও মোহাম্মদপুরে ব্লক রেইড করে ছিনতাইকারীদের আইনের আওতায় আনি। গুলশানে (ভাটারায়) এএসআই মেসবাহ উদ্দিন নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এক চাঁদাবাজকে দৌড়ে একাই হাতেনাতে গ্রেফতার করেন। তাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে ৫০ হাজার টাকা নগদ পুরস্কার দিয়েছি। আইজি মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলে তাৎক্ষণিকভাবে তার জন্য বিপিএম পদকের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসংক্রান্ত একটি প্রস্তাব এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। শিগগিরই অনাড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তার হাতে পদক তুলে দেওয়া হবে।

ডিএমপি প্রধান বলেন, টহল ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে জোরদার করেছি। থানা, ফাঁড়ি, ডিবি এমনকি সিটিটিসি ইউনিটকেও এ কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট করেছি। সিটিটিসির একাংশ এখন ছিনতাইকারী-চাঁদাবাজ দমনে কাজ করছে। তাদের নির্দিষ্ট এলাকা ভাগ করে দিয়েছি। অচিরেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও উন্নতি ঘটবে। গত ১০ দিনে ছিনতাই অনেকটা কমেছে। যেসব ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে সেগুলোর মধ্যে ৮০-৯০ ভাগই মোবাইল ফোনসংক্রান্ত। কেউ যখন যানবাহনের জানালা খুলে মোবাইল ফোনে কথা বলেন, তখন ওতপেতে থাকা ছিনতাইকারীরা মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। উঠতি বয়সের ছেলেপেলেরা এই কাজে জড়াচ্ছে। ভোরবেলা যাত্রীরা যখন রেলওয়ে স্টেশন বা বাস টার্মিনাল থেকে বের হন তখনও কিছু ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। এটা রোধ করতে রাত ৩টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত বিশেষ ব্যবস্থা রেখেছি। এ কারণে গত কয়েকদিনে ছিনতাইয়ের ঘটনা কমেছে।

শেখ সাজ্জাত আলী বলেন, একটি বিশেষ ব্যবস্থা আমরা আজ (রোববার) থেকে শুরু করছি। সেটি হলো জিডি করার ১ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থলে হাজির হবেন। এজন্য প্রতিটি থানা থেকে তিনজন সদস্যকে পুলিশ একাডেমিতে বিশেষ ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। ট্রেনিং শেষে ইতোমধ্যে তারা থানায় যোগ দিয়েছেন। তাদের জন্য একটি করে মোটরসাইকেল ও একটি করে বাইসাইকেল থানায় পাঠানো হয়েছে। এই নতুন ব্যবস্থায় পুলিশি সেবা জনগণের দুয়ারে পৌঁছে দিতে পারব। তিনি বলেন, সব জিডির ক্ষেত্রেই পুলিশ দৌড়াবে না। সার্টিফিকেট-লাইসেন্স হারানোসংক্রান্ত জিডির ক্ষেত্রে ঘটনাস্থলে যাওয়ার দরকার নেই। তবে ঝগড়া-বিবাদ, হাতাহাতিসংক্রান্ত ঘটনায় পুলিশ যাবে। সার্বিকভাবে কোন জিডির ঘটনায় পুলিশ ঘটনাস্থলে যাবে তা তাৎক্ষণিকভাবে নির্ধারণ করবেন থানার ওসি অথবা ডিউটি অফিসার। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ সদস্য থানায় এসে তাৎক্ষণিকভাবে একটি প্রতিবেদন দেবেন। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে সব ওসিকে নির্দেশনা দিয়েছি।

এক প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি কমিশনার বলেন, আমরা রাজধানীর প্রত্যেক থানায় সিটিজেন ফোরাম গঠন করছি। এখানে ছাত্র, শিক্ষক, ব্যবসায়ীসহ সব শ্রেণির লোকজন প্রতিনিধি হিসাবে থাকবেন। সাধারণত তারা থানাকে সহযোগিতা করবেন। কোনো বিষয় নিয়ে যখন ক্রাইসিস দেখা দেবে, সামাজিক জটিলতা দেখা দিলে, অপরাধ প্রবণতা বেড়ে গেলে থানার ওসি তাদের সহযোগিতা নেবেন। সিটিজেন ফোরামের কমিটি হবে ১০ সদস্যবিশিষ্ট। যে কোনো সময়ই তারা থানায় এসে ওসিকে তথ্য দেওয়াসহ নানা ধরনের সহযোগিতা করতে পারবেন।

রাজধানীর বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি জানতে চাইলে পুলিশ কমিশনার সাজ্জাত আলী বলেন, বতর্মানে আইনশৃঙ্খলার বিঘ্ন ঘটছে রাস্তায়। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তাদের ছোটখাটো দাবি-দাওয়া নিয়েও রাস্তায় নেমে পড়ছেন। তারা রাস্তায় সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন। এতে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ব্যাপক হারে বিঘ্ন ঘটছে। আমি সবার কাছে অনুরোধ করব, কারও কোনো দাবি-দাওয়া থাকলে যেন টেবিলে বসে সমাধান করেন। খোলা পরিবেশে সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করুন। রাস্তায় সমাধান খোঁজার চেষ্টা করবেন না। রাস্তায় সব সমস্যার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করা হলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ে অনেক। ভঙ্গুর ট্রাফিক ব্যবস্থা আরও নাজুক হয়ে পড়ে।

এক প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি কমিশনার বলেন, আমরা টহল আগের চেয়ে অনেক বাড়িয়েছি। একটি পত্রিকায় আজ রিপোর্ট দেখলাম, তারা রাজধানীর ৭০ কিলোমিটার ঘুরে কোনো টহল পুলিশ পাননি। এটা আমাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়। টহল পার্টি নেই-এটা হতেই পারে না। সিটিটিসিকে পর্যন্ত টহলে নামিয়েছি। ডিবি ও ফাঁড়ির তৎপরতা জোরদার করেছি। দুজন সহকারী কমিশনার রাতের টহল ব্যবস্থাপনা মনিটরিং করেন।

তিনি বলেন, যেসব পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অপকর্মে জড়ানোর অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তাদের বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। আমরা তাদের হেফাজতেও নিচ্ছি। একজন ওসিকে কুষ্টিয়া থেকে ধরে নিয়ে এসেছি। পরে থানা থেকে পালিয়ে গেছেন। পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানার ওসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। যিনি পালিয়ে গেছেন তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। কেউ কেউ বলছেন যে ওসিকে আমরা গ্রেফতার করেছি, তাকে ছেড়ে দিয়েছি। এই অভিযোগ সঠিক নয়। যদি আমরা ছেড়েই দিতাম, তাহলে তো কুষ্টিয়া থেকেই ছাড়তে পারতাম।

তিনি আরও বলেন, পুলিশের কোনো সদস্য খারাপ কিছুর সঙ্গে জড়িত হলে অবশ্যই শাস্তি পাবেন। পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মামলা নিতে কালক্ষেপণ করায় গুলশানের ওসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মামলার তদন্তে গাফিলতির কারণে একটু আগে মিরপুরের ওসিকে ক্লোজড করা হয়েছে। আরও বেশ কয়েকজনকে ক্লোজড করা হয়েছে। তিনি বলেন, শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে আমার অবস্থার জিরো টলারেন্স। আমার অফিসার যদি কোনো ধরনের জুলুম-নিপীড়ন ও নির্যাতনে জড়ায়, মামলা না নেয়, অন্যায় করে, তাহলে ডিএমপিতে থাকতে পারবেন না। ডিএমপিতে যোগদানের দিনই আমি মাঠপর্যায়ে এ বার্তা পৌঁছে দিয়েছি। সব অফিসাররা বার্তা পেয়ে গেছেন।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম