বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২৪
তালিকায় ফ্যাসিবাদের দোসর প্রতিবাদের মুখে স্থগিত
গণ-অভ্যুত্থানের চেতনাকে বিবেচনা করা হয়নি * সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় * একটি গোষ্ঠীর প্রাধান্য * ‘হাসিনা দিল্লিতে বসে পুরস্কার দিলেন’
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সম্প্রতি ঘোষিত বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২৪ ঘিরে সমালোচনার ঝড় বইছে দেশের সাহিত্যাঙ্গনে। অভিযোগ উঠেছে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মূল চেতনাকে পাশ কাটিয়ে বিগত আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসর কবি, লেখক, সাহিত্যিকদের পুরস্কৃত করা হয়েছে।
একমাত্র সলিমুল্লাহ খান ব্যতীত পুরস্কারের জন্য ঘোষিত হওয়া সব লেখক, সাহিত্যিক আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী-এমন মন্তব্যও সবখানে। ফেসবুকসহ নানা সোশ্যাল মিডিয়ায় জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং সাহিত্যাঙ্গনের অনেকেই সমালোচনা করছেন। একটি বিশেষ পত্রিকার ‘লেখক’দের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, শেখ হাসিনা দিল্লিতে বসে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দিলেন-এমন বক্তব্যও বাদ যায়নি।
এদিকে সমালোচনার মুখে শনিবার রাতে পুনর্বিবেচনার জন্য পূর্বঘোষিত ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২৪’ স্থগিত করেছে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ। সাহিত্য পুরস্কার কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। উদ্ভূত সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এবং পুরস্কার-তালিকাভুক্ত কারও কারও সম্পর্কে কিছু অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ায় পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন বলে আলোচনা হয়।
উত্থাপিত অভিযোগ সম্পর্কে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অনধিক ৩ কর্মদিবসের মধ্যে পুনর্বিবেচনার পর তালিকাটি পুনঃপ্রকাশ করা হবে।
বৃহস্পতিবার এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণা করে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর থেকেই বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক ও আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ২০২৪ সালের জন্য এ পুরস্কারের জন্য মনোনীতরা হলেন-কবিতায় মাসুদ খান, কথাসাহিত্যে সেলিম মোরশেদ, নাটক ও নাট্যসাহিত্যে শুভাশিস সিনহা, প্রবন্ধ-গদ্যে সলিমুল্লাহ খান, শিশুসাহিত্যে ফারুক নওয়াজ, অনুবাদে জিএইচ হাবীব, গবেষণায় মুহম্মদ শাহজাহান মিয়া, বিজ্ঞানে রেজাউর রহমান, মুক্তিযুদ্ধে মোহাম্মদ হাননান এবং ফোকলোরে সৈয়দ জামিল আহমেদ। অমর একুশে বইমেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাদের হাতে এ পুরস্কার তুলে দেবেন।
বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রস্তাবক কমিটির প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে এবং বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার কমিটির সিদ্ধান্তে একাডেমির নির্বাহী পরিষদ এটি অনুমোদন করে।
পুরস্কারের সমালোচনা করে কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন যুগান্তরকে বলেন, বাংলা একাডেমি জাতীয় মননের প্রতীক। সাম্প্রতিককালে যুগান্তকারী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। সে বিজয় ছিল ফ্যাসিস্ট সরকারের সবকিছু থেকে দেশকে মুক্ত করা এবং সংস্কার করার। একটি কল্যাণকর রাষ্ট্রের রূপ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সেখানে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে স্তাবক, দালাল বিগত সরকারের সুবিধাভোগীদের বাদ দিয়ে প্রকৃত কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, দেশপ্রেমিকদের ঐক্যবদ্ধ করা এবং পুরস্কৃত করার কথা। কিন্তু বাংলা একাডেমি দীর্ঘ ৬ মাস ধরে যে কর্মকাণ্ড করছে, তাতে মনে হয় তারা বিগত সরকারের দোসরদের লালন-পালনের ভার নিয়েছে। সেখানে যারা কর্মরত আছেন তারা বিগত সরকারের সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী। তারা গত ১৭ বছরে আমাদেরকে বাংলা একাডেমিতে প্রবেশ করতে দেননি। আমাদের লেখা ছাপেননি, ডাকেননি। এমনকি আমাদের নাম দেওয়া হলে সেটা কেটে দেওয়া হয়েছে। সে অবস্থা থেকে মুক্তির জন্যই এ আন্দোলন। কিন্তু আন্দোলনের কোনো সুফল আমাদের ঘরে আসছে না।
তিনি বলেন, ২০২৪ সালের ঘোষিত বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে যাকে কবিতায় দেওয়া হয়েছে তিনি দেশেই থাকেন না। তিনি ধর্মের বিরুদ্ধে কবিতা লিখেছেন। বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ সহচর, দালাল বলে জানি। যাকে গল্পে দেওয়া হয়েছে সে-ও তাই। শুধু সলিমুল্লাহ খান ছাড়া বাকি সবাই আওয়ামী ও ফ্যাসিস্টদের দোসর। এই পুরস্কারের সম্মান যদি বাংলা একাডেমিকে রক্ষা করতে হয়, বিপ্লবকে যদি অর্থবহ করতে হয় তাহলে এই পুরস্কার আবার নতুনভাবে বিবেচনায় আনতে হবে এবং প্রকৃত ত্যাগী কবি, সাহিত্যিকদের দিতে হবে। অনেকে বলেছেন, এবারের পুরস্কার একটি পত্রিকার ‘পোস্টার’ হয়ে গেছে। এটিও খতিয়ে দেখা দরকার। কারা বাংলা একডেমিতে এখন চাকরিরত আছেন, তারা কাদের লোক সেটাও বের করতে হবে। নতুন মহাপরিচালক কেন অর্থবহ করে তুলতে পারলেন না, এই ব্যর্থতা কার? প্রশ্ন রাখেন তিনি।
পুরস্কার ঘোষণার পর তরুণ কবি ও জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য সাইয়েদ জামিল তার এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘হাসিনা দিল্লিতে বসে আজ বাংলা একাডেমি পুরস্কার দিলেন। হ্যাঁ, এটাই সত্যি। ঘোষিত পুরস্কারের তালিকা দেখে আজ তাই মনে হলো। হাসিনা ঢাকায় থাকলে এবার এরাই পেতেন এই পুরস্কার।
তিনি পোস্টে আরও লেখেন, বাংলা একাডেমির এই আওয়ামী তোষণের প্রতিবাদ-স্বরূপ আগামী ২ ফেব্রুয়ারি তারিখের আলোচক থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির ২ তারিখ বাংলা একাডেমির মূলমঞ্চে কবি হেলাল হাফিজের ওপর নির্ধারিত অনুষ্ঠানের আলোচক হিসাবে আলোচনা করছি না আমি। ইনকিলাব জিন্দাবাদ। বাংলা একাডেমির আওয়ামী তোষণ নিপাত যাক।
এদিকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারের এই ঘোষণা প্রত্যাহারের জন্য রোববার বাংলা একাডেমি ঘেরাও কর্মসূচি দিয়েছিল বিক্ষুব্ধ কবি লেখক সমাজ।
সংগঠনটির আহ্বায়ক কবি আবিদ আজম যুগান্তরকে বলেন, দেশীয় এবং সাংস্কৃতিক যে সংকট তার মূলে আছেন আসিফ নজরুল। গণহত্যা এবং ফ্যাসিবাদের দোসরদের নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। তিনি শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক থেকে সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা হিসাবে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর নিয়োগে ভূমিকা রেখেছেন। যাদের বিষয়ে তুমুল আপত্তি আছে ছাত্র-জনতার। এর সঙ্গে একটি পত্রিকার গোষ্ঠীও জড়িত। ভিনদেশি আগ্রাসী ভারতীয় ‘র’র এজেন্ট হয়ে তারা এ কাজগুলো করছে।
তিনি বলেন, আমাদের টাকায় চলা বাংলা একাডেমি তার সাহিত্য পুরস্কারকে ভীষণ বিতর্কিত করেছে। ফ্যাসিবাদের শুধু দোসর নয়, যারা গণহত্যায় উসকানি দিয়েছে সেরকম কয়েকজনকে এ বছর পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। তাদের বেশিরভাগই চরমভাবে বিতর্কিত, অযোগ্য ও ফ্যাসিস্ট। পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম-নীতি মানা হয়নি। কারা ফেলো ছিল, কারা অনুমোদন দিয়েছে তা-ও স্পষ্ট নয়। জানতে পেরেছি একজন সম্পাদকের ভাইকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। অথচ তার নাম কোনো ফেলো প্রস্তাব করেননি। শিশুসাহিত্যে ফারুক নওয়াজ এবং মুক্তিযুদ্ধে মোহাম্মদ হাননান তারা দুজনই চরমভাবে আওয়ামীপন্থি, সুবিধাবাদী। দলটির ফ্যাসিবাদকে পুনরুজ্জীবিত করতে তারা নানারকম তৎপরতা দীর্ঘদিন করেছেন। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে গালাগাল করেছেন, ছাত্র-জনতাকে রাজাকার, জঙ্গি বলেছেন।
তিনি বলেন, আমাদের দাবি অবিলম্বে এই পুরস্কার বাদ নিয়ে নতুন করে বিবেচনা করা হোক। বাংলা একাডেমিতে গত স্বৈরাচার সরকারের যারা দোসর আছে তাদের অপসারণ করা হোক। আরও কিছু সুনির্দিষ্ট দাবি নিয়ে রোববার আমরা বাংলা একাডেমি ঘেরাও করব। আমাদের সংগঠনের সঙ্গে আরও কয়েকটি সংগঠন থাকবে। আমরা অবস্থান কর্মসূচি এবং এ পুরস্কার প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করব।
এদিকে, শুক্রবার রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে স্ট্যাটাস দিয়ে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেছেন, বাংলা একাডেমি পুরস্কারের সঙ্গে মন্ত্রণালয় বা আমার ব্যক্তিগত কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের সরাসরি ভূমিকা আছে একুশে পদকের ক্ষেত্রে। তারপরও মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসাবে আমি এই পুরস্কার নিয়ে যে সমালোচনাগুলো হচ্ছে সেটা গ্রহণ করছি।
তিনি আরও লেখেন, একজন নারী লেখককেও খুঁজে না পাওয়া বিস্ময়কর। এছাড়া কিছু ক্যাটাগরিতে যে প্রশ্ন উঠেছে সেগুলোও অযৌক্তিক নয়। সময় এসেছে, এই পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন প্রক্রিয়া সংস্কারের। তিনি আরও লেখেন, একইসঙ্গে একাডেমিকে একটা বিশেষ গোষ্ঠীর মিলনমেলা না বানিয়ে কী করে ইনক্লুসিভ করা যায়, কী করে তরুণ মেধাকে এর চালিকাশক্তির অংশ করা যায় সেটা নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে।