জুলাই বিপ্লব: অশ্রুমেদুর কাহিনি
ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন শেষ সামনে শুধুই অন্ধকার
ছেলেকে সুস্থ করতে একাই যুদ্ধ করছেন মা
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
নাসমুস সাকিব মাহিম
আঠারো বছরের কিশোর নাজমুস সাকিব মাহিম। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক পলিটেকনিক কলেজের ছাত্র। বিষয় ‘রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ারকন্ডিশন’।
স্বপ্ন ছিল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে সংসারে সচ্ছলতা আনবেন। কিন্তু সবকিছুই থমকে গেছে এক ঝড়ো হাওয়ায়। গত বছর ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হন মাহিম। এরপর কয়েক হাসপাতাল ঘুরে বর্তমানে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
সেখানকার এক নম্বর ওয়ার্ডের ৬নং বিছনায় শুয়ে সুস্থতার আশায় দিন গুনছেন। কিন্তু সুস্থ হতে আর কতদিন লাগবে, তা তিনি বলতে পারছেন না। চোখে-মুখে গভীর এক হতাশা।
চিকিৎসকের বরাত দিয়ে স্বজনরা জানিয়েছেন, মাহিম সুস্থ হলেও স্বাভাবিক কাজকর্ম তেমন করতে পারবেন না। এরপরও ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সেই স্বপ্ন হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে। বৃহস্পতিবার দুপুরে মাহিমের মা তাহমিনা আক্তার এ প্রতিবেদককে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঘিরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে মাহিম গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা চলে আসেন।
প্রতিদিনের মতো ৫ আগস্ট দুপুরে ছাত্র-জনতা দেবিদ্বার পুরান বাজার এলাকায় মিছিল নিয়ে বের হয়। ওই মিছিলে অংশ নেন মাহিম। সেসময় স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও পুলিশ একজোট হয়ে মিছিলে হামলা চালায়। তখন মাহিমসহ অর্ধশত মানুষ গুলিবিদ্ধ হন। মাহিমের পেটের খাদ্যনালি ছিঁড়ে নাড়িভুঁরি বেড় হয়ে যায়! ওর সহযোদ্ধরা প্রথমে দেবিদ্বার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালে নিয়ে যায়।
পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় চিকিৎসকরা রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। সেখানে দীর্ঘ প্রায় চার মাস চিকিৎসা শেষে ৯ ডিসেম্বর থেকে ঠাঁই হয়েছে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে।
তাহমিনা আক্তার বলেন, চিকিৎসকরা তিনবার অস্ত্রোপচার করে পেটের মধ্যে ঢুকে থাকা কিছু ছররা গুলি বেড় করছে। আরও ২৫৬টি গুলি ভেতরে রয়ে গেছে। নাড়িভুঁরি বেড় হয়ে যাওয়ায় খাদ্যনালির সঙ্গে সংযুক্ত করে পেটে ফিস্টুলার মাধ্যমে ব্যাগ পরিয়ে দেওয়া হয়েছে; যা দিয়ে ময়লা বেড় হয়। ক্ষতস্থানে ইনফেকশন হওয়ায় পুঁজ ও পানি বের হয়। ড্রেসিংয়ের জন্য পেটের ডান পাশের সামনের দিকে গজ ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে।
কিছু ওষুধ শরীরে কাজ করছে না। টানা কয়েক মাস শোয়া থেকে উঠে বসতেও পারতেন না। মুখে খাবার খেতে পারতেন না। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মাস তিনেক পর আরও দুটি অস্ত্রোপচার হবে। সুস্থ হতে দীর্ঘসময় লাগবে। বেঁচে থাকলেও ভবিষ্যতে স্বাভাবিক কাজকর্ম করা কঠিন হয়ে পড়বে।
তিনি আরও বলেন, ওর বাবা হারুন অর রশীদ সামান্য বেতনে দুবাইয়ে একটি বাড়িতে কেয়ারটেকারের কাজ করেন। ইচ্ছা ছিল ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার করে দুবাইয়ে চাকরি দিয়ে নিজে দেশে ফিরবেন। ছেলে পলিটেকনিক কলেজের দ্বিতীয়বর্ষ পর্যন্ত ভালো রেজাল্টও করেছিল। কিন্তু হাসিনার পুলিশের গুলিতে সব পরিকল্পনা এলোমেলো হয়ে গেল। ওর বাবা হার্টের রোগী। দুর্ঘটনার খবরে দেশে এসেছিলেন। জীবিকার তাগিদে ফের চলে যেতে হয়েছে।
মাহিমের মা যুগান্তরের কাছে আক্ষেপ নিয়ে জানান, সরকার আহতদের পুনর্বাসনে একটি ক্যাটাগরিভিত্তিক তালিকা প্রণয়ন করছে। কুমিল্লা সিভিল সার্জন অফিস মাহিমকে ‘ডি’ ক্যাটাগরিতে ফেলেছে। কিন্তু তারা কখনো এসে পরিস্থিতি দেখেনি। এ বিষয়ে কথা বলতে বুধবার শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়েছিলাম। সেখানকার চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তারা এখনো ক্যাটাগরি করেননি। কুমিল্লা সিভিল সার্জনকে ফোন দেওয়ার পর তিনি জানিয়েছেন মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যোগাযোগ করতে।
তিনি বলেন, সোহরাওয়ার্দীতে প্রথম অস্ত্রোপচারের পর ১০ দিন (৫-১০ আগস্ট) পোস্ট অপারেটিভে নিবিড় পরিচর্যায় ছিল। সিএমএইচ-এ আনার পরও অস্ত্রোপচার করে তিনদিন (২৭-৩০ ডিসেম্বর) আইসিইউ, দুইদিন এইচডিইউ এবং পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে তিনদিন ছিল। এভাবে প্রায় ছয় মাস বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আশপাশের বিছানার অনেক রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। কিন্তু আমরা একদিনের জন্যও বাড়ি যেতে পারিনি
। শুরুর দিকে অনেক টাকাপয়সা খরচ হলেও হিসাব রাখা সম্ভব হয়নি। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে থাকতে গণভবন স্টাফ কোয়ার্টারে মাসিক ১৪ হাজার টাকায় একটি কক্ষ ভাড়া নিয়েছিলাম। হাসপাতাল পরিবর্তন ও খরচ জোগাতে না পেরে সেটিও ছেড়ে দিয়েছি। কলেজ পড়ুয়া ছোট ছেলেকে ব্রহ্মণবাড়িয়ায় একটি মেসে এবং ১৪ বছর বয়সি মেয়েকে ননদের বাড়ি রেখে ছেলেকে নিয়ে আমি একা হাসপাতালে দিন কাটাচ্ছি।