দাগনভূঞায় বেপরোয়া বিএনপির সন্ত্রাসীরা
চাঁদা দিলে রক্ষা, নইলে মামলা-হামলার শিকার
নিরাপত্তা শঙ্কায় আইনের আশ্রয় নিতে ভয় পাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা
দাগনভূঞা (ফেনী) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফেনীর দাগনভূঞায় চলছে চাঁদাবাজির ‘মহোৎসব’। ৫ আগস্টের পর থেকে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, ব্যবসায়ী ও প্রবাসীদের হুমকি দিয়ে তাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে যাচ্ছে একটি চক্র।
চাঁদা দিলে ওই ব্যবসায়ী ও প্রবাসীর পরিবার নিরাপদ। আর না দিলে হতে হচ্ছে হামলা অথবা মামলার শিকার। এই চাঁদাবাজরা বিএনপির ছত্রছায়ায় রয়েছে বলে মন্তব্য করেছে স্থানীয় জামায়াতে ইসলামী। তবে বিএনপি বলছে, চাঁদাবাজরা ঢাল হিসাবে বিএনপির নাম ব্যবহার করছে।
অন্যদিকে চাঁদাবাজি, হামলা-মামলার সঙ্গে কারা জড়িত, তা প্রকাশ করতে ভয় পান ভুক্তভোগীরা। তারা বলছেন, নাম প্রকাশ করলে তাদের প্রাণনাশের হুমকি রয়েছে। পুলিশ বলছে, তাদের কাছে এসব বিষয় নিয়ে কেউ অভিযোগ করছে না। হুমকি পেলে অভিযোগ করার আহ্বান জানিয়েছে পুলিশ।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ৫ মাসে দাগনভূঞায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চাঁদাবাজ ও ডাকাতচক্র। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে মামলা থেকে অব্যাহতি ও হয়রানি থেকে মুক্তির আশ্বাস দিয়ে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের পলাতক বা এলাকায় থাকা নেতাকর্মী, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে যাচ্ছে ওই চক্রটি। বাদ যাচ্ছেন না প্রবাসীরাও। দাবি করা চাঁদা না দিলে হতে হচ্ছে হামলা-মামলার শিকার। কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বা বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটাচ্ছে ওই চক্র।
গত রোববার রাতে ককটেল ও ফাঁকা গুলি ছোড়ে দাগনভূঞা উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের জাঙ্গালিয়া গ্রামে প্রবাসী বেলাল হোসেন খোকার বাড়িতে হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। তারা তার বাড়ির দেওয়াল ভেঙে ফেলে। এ ঘটনায় নেতৃত্ব দেন সেনবাগের যুবদল নেতা সুলতান সালাউদ্দিন লিটন। এমন অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা। তবে এ ঘটনাকে পারিবারিক বিরোধ বলেছেন স্থানীয় অনেকেই।
এদিকে রোববার রাতে দাগনভূঞা বাজারের ইব্রাহীম পেট্রোল পাম্পের মালিক মো. বাদশাকে কুপিয়ে জখম করে সন্ত্রাসীরা। বাদশা জানান, বিএনপির একদল সন্ত্রাসী তার কাছে ১৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। একপর্যায়ে তার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়। রাতে পাম্প থেকে বাড়ি ফেরার পথে সন্ত্রাসীরা তাকে বেধড়ক মেরে মাথা ফাটিয়ে দেয়। বর্তমানে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। খবর পেয়ে ওসি ও তার ফোর্স হাসপাতালে ছুটে যান। তাকে মামলা করার জন্য বললেও জখম হওয়া ব্যবসায়ী বাদশা রাজি হননি।
তিনি যুগান্তরকে বলেন, মামলা করলে আমার ব্যবসা ও পরিবারের নিরাপত্তা দেবে কে? শনিবার রাতে দাগনভূঞার আল আমিন ব্রিক ফিল্ডের শ্রমিকদের থাকার ঘরে ডাকাতি হয়। ডাকাতদল দরজা ভেঙে প্রবেশ করে শ্রমিকদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ৬৫ হাজার টাকা এবং ৪/৫টি মোবাইল ফোন নিয়ে যায়।
শ্রমিকরা জানান, দাগনভূঞা পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ড কৃষ্ণরামপুর গ্রামের হোসেন মিস্ত্রির ছেলে হাসান, মাসুদের ছেলে করিম, ভাড়াটিয়া জুয়েলসহ একদল ডাকাত রাত ১০টার দিকে দরজা ভেঙে শ্রমিকদের ঘরে প্রবেশ করে। সদর ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার রফিকুল ইসলাম লাভলুর বাড়ির গ্রিল কেটে একধিকবার চুরি, করিমপুরে সিরাজের দোকানে চুরি, সাহাব উদ্দীনের বাড়িসহ উপজেলার অনেক বাড়ি ও দোকানে চুরির ঘটনা ঘটেছে।
অপরদিকে দাগনভূঞা বাজারে রেজিস্ট্রেশনবিহীন সিএনজি অটোরিকশা, বাজারের ফুটপাত দখল করে গড়ে ওঠা দোকানপাট থেকেও প্রতিদিন আদায় করা হচ্ছে হাজার হাজার টাকা।
উপজেলাজুড়ে বেপোরোয়া চাঁদাবাজি নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন সাধারণ মানুষ। তারা চাঁদাবাজি, চুরি, ডাকাতি বন্ধে প্রশাসনের জোরালো হস্তক্ষেপ কামনা করেন। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) দাগনভূঞা শাখার সভাপতি মো. আবু তাহের বলেন, জনশ্রুতি রয়েছে দাগনভূঞায় ব্যাপক চাঁদাবাজি হচ্ছে। তবে কেউ কারও নামে কোনো অভিযোগ দিতে ভয় পাচ্ছে। এসব অপকর্ম অব্যাহত থাকায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফসল দ্বিতীয় স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। চাঁদাবাজদের প্রতিহত করতে ভুক্তভোগীরা যেন প্রশাসনের শরণাপন্ন হন।
দাগনভূঞা উপজেলা জামায়াতের আমির গাজী ছালেহ উদ্দিন বলেন, দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে এতবড় বিপ্লবের পরও এখনো আমরা শুনতে পাই অহরহ চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে। কৃষিজমির মাটি লুট হচ্ছে। শুনতে পাই, কথিত ওই চাঁদাবাজরা তাদের বড় ভাই বিএনপির বিভিন্ন গ্রুপের নেতাদের ছত্রছায়ায় আছে।
দাগনভূঞা উপজেলা বিএনপির সভাপতি আকবর হোসেন বলেন, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, চোর, ডাকাত এদের কোনো দল নেই। এরা নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে দলকে সাইনবোর্ড হিসাবে ব্যবহার করে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশ রয়েছে কোনো সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ যাতে দলের ভেতরে না থাকে। তাই এসব কাজের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা বিএনপির কেউ না। কেউ দলের নাম বিক্রি করে চাঁদাবাজি করলে প্রশাসন যেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে প্রশাসন উপজেলা বিএনপির কোনো সহযোগিতা চাইলে আমরা শতভাগ সহযোগিতা করব।
দাগনভূঞা থানার ওসি লুৎফুর রহমান বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের চাঁদাবাজির অভিযোগ কেউ দেয়নি। শুধু চাঁদাবাজ নয়, দাগনভূঞায় যে কোনো সন্ত্রাসী ও বেআইনি কার্যক্রমের সঙ্গে যেই জড়িত থাকুক পুলিশ আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে। চাঁদা দাবি করলে পুলিশকে জানানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, কোনো সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজের স্থান দাগনভূঞায় হবে না।