জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান
আহতদের ক্যাটাগরি নির্ধারণে বৈষম্য!
জুলাই বিপ্লব: অশ্রুমেদুর কাহিনি
জাহিদ হাসান
প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আহতদের ক্যাটাগরিভিত্তিক তালিকা প্রণয়নে বৈষম্যের শিকার হওয়ার অভিযোগ করছেন রোগীরা। তারা বলছেন, সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ’ এবং ‘গণ-অভ্যুত্থানসংক্রান্ত বিশেষ সেল’ তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছে। আহত হওয়ার ধরন ও মাত্রা অনুযায়ী ‘এ’, ‘বি’, ‘সি’ ও ‘ডি’ ক্যাটারিতে ভাগ করে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে অনেকে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
সরেজমিন রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসাধীন একাধিক রোগী ও স্বজনের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে। তবে তালিকা প্রণয়ন ও তথ্য সংগ্রহকারী সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী ক্ষতের ধরন ও পরিমাণ যাচাই-বাছাই করে আহতদের ‘ক্যাটাগরি’ নির্ধারণ করা হচ্ছে।
বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টা। পঙ্গু হাসপাতালের তৃতীয়তলার মডেল ‘বি’ ওয়ার্ডের ১৭নং বিছানায় বসে থাকতে দেখা যায় বৈষম্যবিরোধী অন্দোলনে আহত যুবক মো. মেহেদী আলমকে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, রাজধানীর গুলশান-১-এ একটি ফুলের দোকানে কাজ করতেন। দেশকে মুক্ত করতে গিয়ে একটি পা হারাতে বসেছেন। সরকার সহায়তা ও পুনর্বাসনে তাকে তালিকাভুক্ত করছে। তবে এখানেও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
মেহেদী জানান, গত ১৮ জুলাই রামপুরার বিটিভি ভবনের সামনে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। ওইদিন রাতে বিজিবি সদস্যদের ছোড়া বুলেট তার বাম পায়ের হাঁটুর নিচে হাড় ভেদ করে যায়। বর্তমানে পায়ের ৬ ইঞ্চি হাড় নেই। আহত হওয়ার পর সহযোদ্ধরা রামপুরার ডেল্টা হাসপাতালে নিলে সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়। পরিস্থিতি মারাত্মক হওয়ায় ঢামেক হাসপাতালের চিকিৎসকরা পঙ্গু হাসপাতালে পাঠান। এখানে ভর্তির পর অস্ত্রোপচার করে পায়ে ৬টি রড বসানো হয়। পরের মাসে আরও দুইবার অস্ত্রোপচার করার পর ‘ইলিজার্ভ’ যন্ত্র বসানো হয়। চিকিৎসকরা এখন পর্যন্ত ১২ বার অস্ত্রোপচার করেছেন। পায়ে বসানো ইলিজার্ভ খুলবেন ৮ মাস পর। এ সময় নিয়মিত ড্রেসিং ও পরীক্ষা দরকার। হাড় জোড়া লাগার পর নার্ভ ইনজুরি চিকিৎসা লাগবে। সবমিলে প্রায় দুই বছর চিকিৎসা নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, পুনর্বাসন তালিকায় আমাকে ‘সি’ ক্যাটাগরি দিয়েছে। শুনেছি শরীয়তপুর জেলা সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল টিম পায়ের ক্ষতের ছবি দেখে ক্যাটাগরি করেছে। ক্যাটাগরি পরিবর্তনে টিমকে একাধিকবার ফোন দিলেও কেউ সাড়া দেননি।
চিকিৎসা সংক্রান্ত অন্তত ১২টি মেডিকেল রিপোর্ট দেখিয়ে ৪০ নম্বর শয্যায় ভর্তি থাকা সাইফুল ইসলাম জানান, ৪ আগস্ট ফেনীর মহিপাল ফ্লাইওভারের নিচে ছাত্রলীগ ও পুলিশ ধাওয়া দেয়। ওই সময় একে একে ৮টি গুলি তার বাম পায়ে লাগে। একটা গুলি লিভারের বাম পাশ ভেদ করে কিডনির পাশে মেরুদণ্ডের হাড়ে লাগে। যেটি এখনো শরীরে রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল, নিউরোসায়েন্স, সিএমএইচ ও পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মেরুদণ্ডের গুলি বের করতে গেলে কিডনি, মূত্রথলি এবং রক্তনালি ছিঁড়ে যেতে পারে। তাই অপারেশন করা যাবে না। আমি গুরুতর আহত। অথচ রেখেছে ‘সি’ ক্যাটাগরিতে। আমার বাবা-মা কেউই নেই। তাই দাবি, ‘এ’ ক্যাটাগরিতে রেখে ভাতার আওতায় আনা হোক।
আহতদের ক্যাটাগরি করায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন স্নাতকের শিক্ষার্থী মো. তারেক বিন হাসান। তিনি বলেন, আমার শরীরে ৫টি বুলেট লাগে, যা অপসারণে একটি হাতে কনুই থেকে নিচ পর্যন্ত একাধিকবার অস্ত্রোপচার করাতে হয়েছে। কাটা শুকিয়ে গেছে; কিন্তু হাতে কোনো শক্তি পাই না; বোধও নেই। এক হাতে কাজ না করতে পারলে কীভাবে আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরব আমাকে ফেলেছে ‘ডি’ ক্যাটাগরিতে।
পঙ্গু হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. বদিউজ্জামান বলেন, আহতদের পুনর্বাসনে ‘এ’ ক্যাটাগরিতে অতিগুরুতর আহত, যাদের আজীবন সাহায্যের আওতায় আনতে হবে, তাদের রাখা হয়েছে। ‘এ’ ক্যাটাগরিতে যারা থাকবে-উভয় হাত/পাবিহীন, সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন, সম্পূর্ণভাবে মানসিক বিকারগ্রস্ত এবং কাজ করতে অক্ষম বা অনুরূপ আহত ব্যক্তি। ‘বি’ ক্যাটাগরিতে থাকবে-গুরুতর আহত, যাদের দীর্ঘদিন সাহায্য দিতে হবে, এক হাত/পা বিচ্ছিন্ন, আংশিক দৃষ্টিহীন, মস্তিষ্কে গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত বা অনুরূপ আহত ব্যক্তি। ‘সি’ ক্যাটাগরিতে আছেন-আহত যারা এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন কিংবা সুস্থ হতে আরও চিকিৎসা প্রয়োজন এবং স্বাভাবিক কার্যক্রম করতে সক্ষম হবেন। যেমন: শ্রবণশক্তি/দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত, গুলিতে আহত বা অনুরূপ আহত ব্যক্তি। ‘ডি’ ক্যাটাগরি হচ্ছে-সাধারণ আহত, যারা আহত হওয়া সত্ত্বেও ইতোমধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করেছেন এবং স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে সক্ষম ব্যক্তি।
পঙ্গু হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. আবুল কেনান যুগান্তরকে জানান, তার হাসপাতালে এ পর্যন্ত ২১ জন হাত-পা কাটা রোগী পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ক্যাটাগরি করছেন। জেলা সিভিল সার্জনরা কো-আর্ডিনেট করছেন। কারা কোন তালিকায় পড়বেন, এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় ছক আকারে নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু আহতদের অনেকে না বুঝে নিজেদের মতো করে চাচ্ছেন।