ব্যালটে ইসলামপন্থি দলগুলোকে একসঙ্গে চায়
জামায়াতের নির্বাচনি ঐক্যে বাধা মতাদর্শিক দূরত্ব
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে ইসলামি দলগুলো। পাঁচ মাসে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে মাঠে শক্তির মহড়া দিচ্ছে তারা। শুধু তাই নয়, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নিজেদের মধ্যে কীভাবে ঐক্য গড়ে তোলা যায়, তা নিয়েও সমমনাদের সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছেন আলাপ-আলোচনা। ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ‘নির্বাচনি ঐক্য’ গড়ে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লড়ার চিন্তা করছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। সেক্ষেত্রে একটি আসনে একজন করে প্রার্থী দেওয়ার বিষয়ে ‘সমঝোতার’ চেষ্টা চলছে। মঙ্গলবার বরিশালে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান ও ইসলামী আন্দোলনের আমির চরমোনাই পির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের যৌথ সংবাদ সম্মেলন রাজনৈতিক অঙ্গনে চমক সৃষ্টি করেছে। দল দুটির সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে ডালপালা মেলেছে। তবে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদীর প্রতিষ্ঠা করা জামায়াতের সঙ্গে অন্যদের আকিদাগত মতপার্থক্য আছে। আর এটিই বৃহত্তর ঐক্যের পেছনে বড় বাধা বলে মনে করছে অন্য দলগুলো। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
এছাড়া ঐক্য গঠনে বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে নেতৃত্ব কে দেবে-জামায়াতে ইসলামী নাকি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। পাশাপাশি ঐক্য গড়ার আগে কয়েকটি দলের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আবুল আ’লা মওদুদীর ধর্মীয় বিষয়ে কিছু লেখা বা বক্তব্য নিয়ে আলেমদের সঙ্গে যে বিরোধ, এর সমাধান করার কথা জানিয়েছেন। তা না হলে বেশির ভাগ ইসলামি দল ঐক্যে না থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। আবার বেশ কয়েকটি দল বলছে, আলেমদের সঙ্গে বিরোধ মেটানোর চেষ্টা করছে জামায়াত। সেক্ষেত্রে নির্বাচনি ঐক্য না হয়ে নির্বাচনি সমঝোতাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে একটি আসনে একজন করে প্রার্থী থাকবে-সেই সমঝোতার চেষ্টা করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার বরিশাল সদর উপজেলার চরমোনাই মাদ্রাসা ও পিরের দরবার পরিদর্শনে যান জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান। পরে চরমোনাই মাদ্রাসায় জামায়াত আমির ও চরমোনাই পির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন। এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে জামায়াত আমির বলেন, ‘আমরা মূলত ইসলামি দলগুলোর মধ্যে ঐক্য দেখতে চাই। আমাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। জনগণের প্রত্যাশা-নির্বাচনের সব কেন্দ্রে ইসলামি দলগুলোর যেন একটা বাক্স থাকে।’ চরমোনাই পির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেন, ‘নির্বাচনের সময় ইসলামের পক্ষে একটা বাক্স কেন্দ্রে পাঠানোর প্রচেষ্টা আগেও ছিল, এখনো চলছে। বিভিন্ন কৌশলে ৫৩ বছর ইসলামি দলগুলোকে দূরে রাখা হয়েছে। ৫ আগস্ট নতুন স্বাধীনতার মাধ্যমে ইসলামি পক্ষগুলোর একটি ভালো ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। সেই ক্ষেত্রের যদি আমরা সময়োপযোগী বিচার না করতে পারি, তাহলে আমাদের জন্য তা হবে অকল্যাণকর।’ এরপর মূলত রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা শুরু হয়েছে, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন কোনো জোট গড়তে যাচ্ছে কি না।
এ প্রসঙ্গে ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ যুগান্তরকে বলেন, ঐক্য নিয়ে আলোচনা চলমান। এর লক্ষ্য হলো ইসলামি শক্তিগুলোকে এক জায়গায় আনা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে বিভিন্ন রকমের আলোচনা আছে। কেউ কেউ বলছেন জামায়াতে ইসলামী বাদে যারা কওমি উলামায়ে কেরাম আছেন, কওমিধারার, তারা এক জায়গায় এলে পরে তাদের (জামায়াত) বিষয়ে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আবার কারও কারও দৃষ্টিভঙ্গি-একেবারে জামায়াতসহ কেউ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় না থেকে এক জায়গায় হওয়ার। আমরা পর্যবেক্ষণে রাখছি এবং যোগাযোগ রক্ষা করে চলছি। এটি ধাপে ধাপে এগুচ্ছে বলে আমার মনে হচ্ছে। নির্বাচনের কাছাকাছি গেলে চূড়ান্ত অবস্থায় রূপ দেওয়া যাবে।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আব্দুল কাদের বলেন, নির্বাচনি ঐক্য মানে একটি আসনে একজন করে প্রার্থী থাকবে। সেটা নিয়ে আলাপ করার চেষ্টা করছি। নির্বাচনে ইসলামি দলগুলো নিজেদের একাধিক প্রার্থীর বিরুদ্ধে লড়াই না করা-এটাই আমরা চেষ্টা করছি।
গত ৫ মাসে (বুধবার পর্যন্ত) ২৯ জেলায় সমাবেশ, কর্মী সম্মেলন, পথসভা করেছেন জামায়াতের আমির। এ মাসে কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর ও জয়পুরহাটের সমাবেশেও থাকবেন তিনি। সব সমাবেশে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি ঘটাচ্ছে জামায়াত। এ উপস্থিতি দেখিয়ে দলটি জনসমর্থন প্রমাণের চেষ্টা করছে। তবে দীর্ঘদিন ‘ফেরারি’ অবস্থানে থাকা জামায়াতের রাজনীতির সম্মুখভাগে আসা নিয়ে অনেকের মধ্যে নানা আলোচনা সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ, সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির নেতৃত্বের দূরত্ব তৈরি হয়। যদিও এখন আবারও দুই দলই নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যুতে প্রায় অভিন্ন সুরে কথা বলছে। বিএনপি প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন চায়। প্রায় একই অভিমত জামায়াতেও।
জানা যায়, জামায়াত ১৫ আগস্ট থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক শুরু করে। এর মধ্যে চরমোনাই পিরের ইসলামী আন্দোলন, ১২ দলীয় জোট, জাকের পার্টি, লেবার পার্টি, খেলাফত মজলিস ও ফরায়েজী আন্দোলন উল্লেখযোগ্য। এছাড়া খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, হেফাজতে ইসলামের যুগ্মমহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির আব্দুল মাজেদ আতাহারী, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের (একাংশ) আমির আবু জাফর কাসেমী, জামিয়া মাদানিয়ার মুহতামিম মনিরুজ্জামান কাসেমী, জনসেবা আন্দোলনের আমির ফখরুল ইসলামসহ ব্যক্তিপর্যায়ে বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষক ও আলেমদের সঙ্গে জামায়াতের আমির পৃথক মতবিনিময় করেন।
এসব মতবিনিময়ে অংশ নেওয়া একাধিক দলের নেতা জানিয়েছেন, ইসলামপন্থিদের মধ্যে একটি ঐক্য চায় জামায়াত, বিশেষ করে নির্বাচনি ঐক্য। এ লক্ষ্যে জামায়াত ইতোমধ্যে ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে একটি যোগাযোগের সম্পর্ক তৈরি করেছে। এর মধ্য দিয়ে কার্যত কওমিধারার আলেমদের সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিনের যে বিরোধ বা বিতর্ক, সেটি কমেছে। এখন নির্বাচনি ঐক্য হলে ভালো, না হলেও জামায়াত তাতে খুব সমস্যা দেখছে না। তবে জামায়াত নেতারা মনে করছেন, ইসলামি দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনি ঐক্য হবে কি না, সেটি নির্ভর করছে চরমোনাই পিরের দল ইসলামী আন্দোলনের ওপর। জামায়াতের পর ইসলামপন্থিদের সমর্থনের দিক থেকে এ দলটিকে গুরুত্বপূর্ণ ধরা হয়।
আবার কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম নিজেদের অরাজনৈতিক সংগঠন দাবি করলেও সংগঠনটির নেতাদের অনেকেই বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় যুগ্মমহাসচিব মীর ইদরিস যুগান্তরকে বলেন, হেফাজত রাজনৈতিকভাবে কোনো দল নয়। এ সংগঠনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা আছেন। তারা যদি রাজনৈতিকভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেন, তাদের বিষয়। এতে বাধাও নেই, আপত্তিও নেই। তিনি বলেন, যে কারণে জামায়াতের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব, তা হচ্ছে মাওলানা মওদুদীর কিছু বিষয় নিয়ে উলামায়ে কেরামের আপত্তি। এখন তারা (জামায়াত নেতারা) যদি বলেন যে, মাওলানা মওদুদীর অনেক বিষয় ভালো আছে, ভালো বিষয় গ্রহণ করব আর যেগুলো নিয়ে উলামায়ে কেরামের আপত্তি আছে, সেগুলো বিশ্বাস ত্যাগ করব। সে ঘোষণা দিলে তো কোনো আপত্তি থাকবে না।
জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের বাইরে ‘সমমনা ইসলামি দলসমূহ’ নামে ছয়টি দলের একটি জোট আছে। এই জোটের শরিক দলগুলো হলো জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস (মামুনুল হক), মুসলিম লীগ (আবুল খায়ের), খেলাফত মজলিস (আহমদ আবদুল কাদের), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও ইসলামী ঐক্য আন্দোলন। সমমনা ইসলামি দলের একজন নেতা জানান, ইসলামী ঐক্য আন্দোলন ও খেলাফত আন্দোলন ছাড়া বর্তমানে তাদের জোটে চারটি দল সক্রিয় আছে।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী যুগান্তরকে বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে আদর্শগত মতপার্থক্য আছে। এ মতপার্থক্যগুলো এমন ছোট কোনো বিষয় নয় যে, সেগুলোকে সহজেই আমরা সইয়ে নিতে পারব। কিছু কিছু বিষয় আছে, যেগুলো বড়ই স্পর্শকাতর। এ স্পর্শকাতর বিষগুলোর সুরাহা জাতি চায়। আমাদের দৃষ্টিতে সব নবি নিষ্পাপ। সাহাবায়ে কেরাম সূত্রের মাপকাঠি। কিন্তু তারা (জামায়াত) এ দুই আকিদায় আমাদের সঙ্গে একমত নন। তাদের (জামায়াতের) আকিদা মূলত মওদুদী সাহেবের আকিদা। এ পার্থক্যটা দূর না হওয়া পর্যন্ত আমরা এ ব্যাপারে (নির্বাচনি জোট) আপাতত ভাবছি না।’
এ বিষয়ে গত নির্বাচনে অংশ নেওয়া ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের চেয়ারম্যান সৈয়দ বাহাদুর শাহ মোজাদ্দেদী বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে জামায়াতের আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোনো বৈঠক বা কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। পানি আর তেল যেমন এক হয়নি। তাদের (জামায়াতের) আর আমাদের মতাদর্শ অনেক ভিন্ন। তাই তাদের সঙ্গে আমাদের জোট বা অন্য কিছু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘আবুল আ’লা মওদুদীর মতাদর্শ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদার পরিপন্থি। তাই তাদের সঙ্গে আমাদের মিটিং-মিছিল বা বসার কোনো সম্ভাবনা নেই।’