পোড়া ক্ষত কাটিয়ে উঠতে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ
স্বরূপে ফেরার প্রস্তুতি সংসদ সচিবালয়ের
ক্ষত মেরামতের কাজ এ বছরের মধ্যেই শেষ করা সম্ভব হবে
পোড়া ক্ষতের রেশ কাটিয়ে স্বরূপে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে জাতীয় সংসদ সচিবালয়। এ জন্য চলছে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নেন। তার এই পালিয়ে যাওয়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে মুহূর্তেই হাজার হাজার বিক্ষোভকারী জাতীয় সংসদ ভবনের দিকে ছুটে যান। সংসদ ভবনের দিকে যাওয়ার বিভিন্ন সড়কে স্থাপিত ব্যারিকেড ভেঙে ভেতরে ঢুকে বিক্ষোভকারীরা মিছিল এবং বিজয়োৎসব উদযাপন করেন। এ সময় তাদের মধ্যে থাকা সুযোগ সন্ধানী একটি অংশ সংসদ ভবনের ভেতরে ঢুকে অগ্নিসংযোগসহ ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট করতে দেখা যায়।
এ সময় তারা স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, চিফ হুইপ, হুইপদের কক্ষসহ নয়তলা সংসদ ভবনের প্রায় সব কক্ষ তছনছ করে। ওই এলাকায় অবস্থিত মন্ত্রী, সংসদ-সদস্যদের কার্যালয়, কর্মকর্তাদের বাসভবনও ভাঙচুর করা হয়। কেউ কেউ কম্পিউটার, আসবাবপত্রসহ গুরুত্বপূর্ণ এবং দামি জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়। এসময় অনেকে অধিবেশন কক্ষে গিয়ে সংসদ নেতা, স্পিকার এবং সংসদ-সদস্যদের চেয়ারে বসে উল্লাস প্রকাশ করেন, ছবি তোলেন। অনেকে অধিবেশন কক্ষের ভেতরেই শেখ হাসিনাবিরোধী স্লোগান দিতে থাকেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ওই ঘটনার পর আর্থিক ক্ষতি নিরূপণ করতে সংসদ সচিবালয় থেকে সব উইংয়ে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব চেয়ে ৫ নভেম্বর চিঠি পাঠানো হয়। সহকারী মেইনটেইন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার প্রবীর কুমার সিকদার স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন আইটি সামগ্রী-ডেস্কটপ কম্পিউটার, ল্যাপটপ, প্রিন্টার, স্ক্যানার ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা হারানো গেছে। সংসদ সচিবালয়ে বিভিন্ন দপ্তরে ব্যবহৃত কিংবা অচল অবস্থায় পড়ে থাকা এসব আইটি সামগ্রীর তথ্য সংগ্রহ করা প্রয়োজন। চিঠিতে আরও বলা হয়, এ ছাড়া বিভিন্ন অনুবিভাগ/অধিশাখা/শাখায় অচল অবস্থায় পড়ে থাকা আইটি ডিভাইসসমূহ পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জরুরি ভিত্তিতে আইটি অধিশাখায় বুঝিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।
জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর সংসদ সচিবালয় এবং গণপূর্তের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির হিসাবে ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় ১৫৫ কোটি টাকার মতো। এর মধ্যে সংসদ সচিবালয়ের নিজস্ব খাতের ক্ষতি হয়েছে ৫০ কোটি টাকা। অন্যদিকে সংসদ সচিবালয়ের দায়িত্বে থাকা গৃহায়ন ও গণপূর্তের ক্ষতির পরিমাণ ১০০ কোটি টাকার বেশি। ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত সংসদ সচিবালয়কে সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত করার কাজ শুরু হয়েছে। সংসদ সচিবালয়ের দায়িত্বে থাকা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল একাধিকবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে দ্রুত সংসদ সচিবালয় প্রস্তুত করার নির্দেশনা দেন। এর পরপরই সংসদ সচিবালয় এবং গৃহায়ন ও গণপূর্তের উদ্যোগে শুরু হয় পোড়া ক্ষত মেরামতের কাজ। সংসদ সচিবালয়ের মতে, পুরো কাজ এ বছরের মধ্যেই শেষ করা সম্ভব হবে।
এ ছাড়াও সংসদ ভবন, সংসদ-সদস্য ভবন (মানিক মিয়া ও নাখাল পাড়া), পুরাতন এমপি হোস্টেল, মন্ত্রী হোস্টেল, সচিব হোস্টেল ও সংসদ ভবন আবাসিক এলাকার সার্বিক নিরাপত্তা জোরদার করা এবং এসব এলাকার ভাঙা, হারানো ও ক্ষতিগ্রস্ত মালামাল পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তিনটি কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটিও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে সুপারিশ পেশ করে।
জানতে চাইলে সংসদ সচিবালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, আমরা আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে ১৫৫ কোটি টাকার পরিমাণ পেয়েছি। এর মধ্যে সংসদ সচিবালয়ের আইটি খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন আমাদের যে বাজেট আছে তা দিয়ে অল্প কাজ শুরু করেছি। বিশেষ করে কিছু কম্পিউটার, ইন্টারনেট সংযোগ এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি ঠিক করা হচ্ছে। বাকি কাজ করবে গণপূর্ত।
সরেজমিন সংসদ সচিবালয়ের ভেতরে গিয়ে এখনো ধ্বংসস্তূপের নিদর্শন দেখা গেছে। ৯ তলার বিভিন্ন করিডরে স্তূপ করে রাখা আছে ভাঙচুর করা বিভিন্ন আসবাবপত্র ও কাচের টুকরো। দেয়ালে লেখা রয়েছে বিভিন্ন স্লোগান। আঁকানো আছে বিভিন্ন ধরনের গ্রাফিতি। এরই মধ্যে সংসদ সচিবালয়ের উদ্যোগে পরিষ্কার-পরিছন্ন করার কাজ হয়েছে। তবে এসব গ্রাফিতি মোছার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সংসদ সচিবালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ছাত্র-জনতার স্মৃতি ধরে রাখতে গ্রাফিতি মোছা হয়নি। তবে দেয়ালে কিছু অশ্লীল চিত্র এবং স্লোগান রয়েছে। সেগুলো শিগগিরই মুছে ফেলা হবে। আপাতত কিছু তলায় বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ শেষ হলেও এখনো বেশির ভাগ তলায় (ফ্লোর) রয়েছে ঘুটঘুটে অন্ধকার।
এদিকে সংসদ সচিবালয়ের আসবাবপত্র ও বিভিন্ন বিভাগের ফাইল অগোছালো থাকার কারণে বাইরের দর্শনার্থীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। একই কারণে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশেও। সংসদ সচিবালয়ের মূল গেটে সংসদের নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত সার্জেন্ট অ্যাট আর্মস ছাড়াও সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তা দিচ্ছেন। এছাড়াও সংসদ সচিবালয়ের ভেতরের কয়েকটি তলায় সেনা সদস্যদের নিরাপত্তা দিতে দেখা গেছে।