নার্সিংসেবা মহাবিদ্যালয় ছাত্রী হোস্টেল
সাত বছর ধরে ইসমত আরার দখলে ৫ কক্ষ
৯টি সিটের ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিল দেন না * চারজন অধ্যক্ষ একাধিকবার চিঠি দিলেও কর্ণপাত করেননি

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সাত বছর ধরে অবৈধভাবে সরকারি সেবা মহাবিদ্যালয় (কলেজ অব নার্সিং) হোস্টেলের পাঁচটি কক্ষ দখলে রেখেছেন এক শিক্ষক। তার নাম ইসমত আরা পারভীন। তাই এই স্বেচ্ছাচারিতার কারণে সরকার ২৪ লাখ ৪৮ হাজার টাকা রাজস্ব হারিয়েছে। এছাড়া বিদ্যুৎ বিলের ২১ হাজার টাকা পরিশোধ করেননি। এই শিক্ষক বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএনএ) সাবেক সভাপতি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সাত বছরে কলেজের চারজন অধ্যক্ষ তাকে একাধিকবার চিঠি দিয়ে সিট বাতিল এবং দখলে রাখা কক্ষগুলো ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। কিন্তু কর্ণপাত করেননি ইসমত আরা পারভীন। উলটো ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে নানা সময়ে অত্যাচার চালিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর।
২০১৭ সালে মহাখালীর সেবা মহাবিদ্যলয়ের তৎকালীন অধ্যক্ষ জাসিন্তা অলিম্পিয়া গোমেজ ছাত্রী হোস্টেলের ২১ নম্বর (বর্তমানে ২১১) কক্ষে একটি সিট বরাদ্দ দেন ইসমত আরা পারভীনকে। শর্ত অনুযায়ী ইসমত আরার সিটের ভাড়া হিসাবে প্রতি মাসের বেতন থেকে বাড়ি ভাড়া ভাতার ১০ শতাংশ কেটে রাখা হবে। বিদ্যুৎ বিল বাবদ প্রতি মাসে ২৫০ টাকা ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারি ব্যাংকে জমা দিয়ে চালানের কপি হিসাব শাখায় জমা দিতে হবে। কক্ষে বৈদ্যুতিক হিটার ব্যবহার করা যাবে না। কর্তৃপক্ষ চাইলে যে কোনো সময় সিট বাতিল করতে পারবে। কিন্তু ইসমত আরা এসবের কোনোটাই মানেননি। এমনকি বাকি কক্ষগুলোর ভাড়াও দেননি। এসব ঘটনায় হোস্টেলের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ খোদেজা খাতুন সিট বাতিল করে ইসমত আরাকে চিঠি দেন। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের হাউজ কিপারের কাছে সিটটি বুঝিয়ে দিতে অনুরোধ জানান। ইসমত আরা সাড়া না দেওয়ায় ২০২৩ সালে অধ্যক্ষ আরেকটি চিঠি দেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ২০১৭ সালে আপনার নামে ছাত্রী হোস্টেলের ২১১নং কক্ষের একটি সিট বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরে আপনি কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে একাধিক কক্ষ ব্যবহার করছেন। এতে ছাত্রীদের হোস্টেলে সিট বরাদ্দে সমস্যা হচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে ২০১৮ সাল থেকে আপনার ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারকৃত অতিরিক্ত কক্ষগুলো ছাড়ার জন্য চিঠি দেওয়া হয়। হোস্টেলের শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে ২০২২ সালে আপনার বরাদ্দকৃত সিটটি বাতিল করা হয়েছে। তারপরও আপনি ওই কক্ষগুলো হস্তান্তর করেননি এবং চিঠির জবাবও দেননি। এমন পরিস্থিতিতে ছাত্রীদের হোস্টেলে সিট বরাদ্দ প্রদানের জন্য ৩১ অক্টোবরের (২০২৩ সাল) মধ্যে হোস্টেলে অতিরিক্ত ব্যবহারকৃত কক্ষগুলোসহ বাতিলকৃত ২১১নং কক্ষের সিটটি দায়িত্বরত কর্মকর্তার কাছে বুঝিয়ে দিতে বলা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলেজের একাধিক শিক্ষার্থী যুগান্তরকে বলেন, শিক্ষক ইসমত আরা পারভীনের জন্য একটিমাত্র সিট বরাদ্দ ছিল। তিনি দীর্ঘদিন ধরে হোস্টেলের ৫টি কক্ষে ১০টি সিট দখলে রাখায় ছাত্রীদের আবাসন সমস্যা হচ্ছে। তিনি নিজের সিটের ভাড়া ছাড়া দখলে রাখা বাকি কক্ষগুলোর কোনো টাকা সরকারের কোষাগারে জমা দেননি। প্রত্যেক সিটের মাসিক ভাড়া ৩২০০ টাকা হিসাবে গত ৮৫ মাসে ৯টি সিটের ভাড়া বাবদ সরকারকে ২৪ লাখ ৪৮ হাজার টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন। ২১ হাজার ২৫০ টাকার বিদ্যুৎ বিল দেননি।
কলেজের কয়েকজন শিক্ষক জানান, ইসমত আরা হাজিরা দিলেও ঠিকমতো অফিস করেন না এবং ক্লাস নেন না। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন। তুই-তুকারি সম্বোধন করেন। পরীক্ষায় পাশ করানোর বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থ নেওয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন কাজেও হস্তক্ষেপ করেন। স্থানীয় গণপূর্ত বিভাগ তাকে খুশি করতে না পারলে ক্যাম্পাসের কোনো কাজই করার সাহস রাখে না।
শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, ইসমত আরা হোস্টেলের ডাইনিংয়ে ফ্রি খেলেও প্রতিবেলা অতিরিক্ত খাবার নেন। বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দকৃত ডিম, পেঁয়াজ, আলু, তেল ইত্যাদি জোরপূর্বক নিয়ে আত্মীয় বাড়ি পাঠান এবং বাইরে বিক্রি করেন। কিন্তু পরীক্ষায় ফেল করানোর ভয়ে ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদ করতে সাহস পান না। এমনকি কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই ক্যাম্পাস চত্বরে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষাবাদ করে বাজারে বিক্রি করেন।
কলেজের সাবেক একজন অধ্যক্ষ বলেন, ইসমত আরা ২০১২ সালে সেবা মহাবিদ্যালয়ের ইনস্ট্রাক্টর থাকাকালে জেরিয়াট্রিক নার্সিং প্রোগ্রামে এক মাসের জন্য ফিলিপাইন গিয়েছিলেন। সেখানেও তার বিরুদ্ধে ডলার চুরির অভিযোগ ওঠে। ওই প্রোগ্রামে অংশ নেওয়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তৎকালীন নার্সিং সুপারভাইজার দেশে ফিরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দেন। পরে সেবা পরিদপ্তর (বর্তমানে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর) তদন্ত কমিটি করে।
এছাড়া তিনি প্রভাষক থাকাকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক নার্স নিয়োগের বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বেকার নার্সদের প্ররোচনা দেন। ‘বাংলাদেশ নার্সেস ঐক্য পরিষদ’ গঠন করে সংগঠনটির আহ্বায়ক হিসাবে ২০১৬ সালের ২০ এপ্রিল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন। সরকারি নার্স হয়েও মানববন্ধনে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করায় যুগান্তরে সংবাদ প্রকাশ হয়। ওই ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে অসদচারণের দায়ে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়।
২০১৯ সালের ২৩ মে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে অংশ নিয়ে নার্সিং পেশা সম্পর্কে অসত্য ও বিভ্রান্ত তথ্য উপস্থাপন করেন। এতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সেবা মহাবিদ্যালয় তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়। নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালককে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।
২০১৯ সালের ২৯ নভেম্বর নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের তৎকালীন উপপরিচালকের (শিক্ষা) কক্ষে প্রবেশ করে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর বাণী সংবলিত ছবি উলটিয়ে ছবি তোলেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্তে তা প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। এ ঘটনায় তাকে কেন চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে না বা অন্য কোনো যথোপুযক্ত শাস্তি প্রদান করা হবে না জানিয়ে দুই দফায় কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়।
এসব বিষয়ে কথা বলতে ইসমত আরা পারভীনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। পরে তার মুঠোফোনে একাধিক ফোনকল এবং খুদেবার্তা পাঠানো হলে কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।
কলেজের অধ্যক্ষ মদিনা খাতুন যুগান্তরকে বলেন, আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর কক্ষগুলো ছেড়ে দেওয়ার জন্য তাকে চিঠি দিয়েছি। মৌখিকভাবেও একাধিবার বলেছি। আগের অধ্যক্ষরাও চিঠি দিয়েছিলেন। কিন্তু ইসমত আরার বক্তব্য হলো-কক্ষগুলোতে তার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র রয়েছে, যা নার্সিং অধিদপ্তরসংশ্লিষ্টরা জানেন।