এতিমের হক লুণ্ঠনকারী মোস্তফা জালাল রিমান্ডে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ঢাকা-৭ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য ও বিএমএ সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সোমবার ভোরে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। আওয়ামী লীগের এই নেতাকে গ্রেফতারের খবর শুনে আনন্দ প্রকাশ করেন তার নির্বাচনি এলাকার জনগণ। লালবাগ, চকবাজার এলাকার ভোটাররা বলেন, তিনি একজন দখলবাজ, অত্যাচারী মানুষ ছিলেন। এতিমের হক মেরে খেয়েছেন। এদিকে বিকালে তাকে আদালতে হাজির করে নিউমার্কেট এলাকায় ব্যবসায়ী আব্দুল ওয়াদুদকে গুলি করে হত্যা মামলায় ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জশিতা ইসলামের আদালত তার পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারজানা ইয়াসমিন রাখি এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
সোমবার ভোরে মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে মোহাম্মদপুরের মনসুরাবাদ হাউজিং এলাকা থেকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ডিএমপি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান। তিনি জানান, মোস্তফা জালালের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হত্যাসহ একাধিক মামলা রয়েছে।
গণ-আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট ভারতে চলে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর একে একে গ্রেফতার হতে থাকেন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ও প্রভাবশালী সংসদ-সদস্যরা। পাঁচ মাস পেরিয়ে এসে ঢাকার সাবেক সংসদ-সদস্য ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতা, চিকিৎসক মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে গ্রেফতারের তথ্য দিল পুলিশ।
মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ সংগঠন) ১৯৮১-১৯৮৩ মেয়াদে সভাপতি ছিলেন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসাবে ঢাকা-৭ আসন থেকে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগে ১৯৯১ সালে তিনি ঢাকা-৮ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপির মীর শওকত আলীর কাছে এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে ঢাকা-৭ আসন থেকে অংশ নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হাজী সেলিমের কাছে পরাজিত হন। ২০২২ সালে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে তিনি দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন। ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি। ১৯৯৩ সালে তিনি স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) প্রতিষ্ঠা করেন।
‘এতিমের হক লুণ্ঠনকারী’ : পুরান ঢাকা প্রতিনিধি জানান, আওয়ামী লীগের এই নেতাকে গ্রেফতারের সংবাদ শুনে আনন্দিত তার নির্বাচনি এলাকার জনগণ। লালবাগ, চকবাজার এলাকার ভোটাররা বলেন, তিনি একজন দখলবাজ, অত্যাচারী মানুষ ছিলেন। এতিমের হক মেরে খেয়েছেন। বিরোধ লাগিয়ে রেখেছিলেন এলাকার মানুষের মধ্যে। রাজধানীর আজিমপুরে অবস্থিত স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা ও এতিমখানার সম্পত্তি ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের সংসদ-সদস্যের দখলে ছিল। ২০০৯ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে ঢাকা-৭ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন প্রভাব খাটিয়ে এতিমখানার বিভিন্ন সম্পত্তি দখলে রেখেছিলেন। এর ফলে প্রাপ্য অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে এতিমখানার শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রতিবাদ করতে গেলে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার নির্বাহী কমিটির প্রধান উপদেষ্টা করা হয়। এ সময় তার প্রভাবে ভবনটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১২ সালে শেষ হয় ১৮ তলা আবাসিক-বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের কাজ। এরপর ওই বছরের নভেম্বর মাসে এতিমখানার শিক্ষার্থী মো. হারুন অর রশিদসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে প্রশ্ন করেন, ওই ভবনের মাত্র ১২ শতাংশ এতিমখানার নামে দিয়ে এতিমখানাকে বঞ্চিত করা হয়েছে কিনা এবং এতিমখানা যে ১২ শতাংশই পাবে তার নিশ্চয়তা কী? এই প্রশ্নের পরই তাদের ওপর শুরু হয় নির্যাতন। সে সময় মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন লালবাগ থানার তৎকালীন ওসিকে নিয়ে গিয়ে এতিমখানার স্টাফ ও শিক্ষার্থীদের ভয়ভীতি দেখান। এর পরও প্রতিবাদ বন্ধ না হলে ওই বছরের ১২ ডিসেম্বর তিন-চারজন সাদা পোশাকধারী হারুন অর রশিদকে এতিমখানার মাঠ থেকে তুলে নিয়ে যায় এবং শারীরিক নির্যাতন করে।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনীতিতে মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের সঙ্গে হাজি মোহাম্মদ সেলিমের বিরোধ দীর্ঘদিনের। তাদের বিরোধিতার জের ধরে অনেক নিরীহ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। হাজি সেলিম অসুস্থ হওয়ায় তার লোকজন কিছুটা শ্রিয়মাণ ছিল। এ সুযোগে বাড়তি শক্তি পেয়েছিল ডা. জালালের সমর্থকরা। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেক ভবন এবং জায়গা দখল করে নেন তারা। স্থানীয়রা জানান, হাজি সেলিমের দুর্গের বেশির ভাগ জায়গায় প্রভাব বিস্তার করেছিলেন ডা. জালাল। লালবাগে তার ভাগিনা ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাসান পিল্লুই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন। ডা. জালালের মদদেই পুরান ঢাকার স্থানীয় নেতাদের কেউ কেউ বেপরোয়া চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, মাদক ও দখল বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।