Logo
Logo
×

শেষ পাতা

ঠিকাদার-প্রকৌশলী মিলেমিশে দুর্নীতি

দুই পাশে খাল কেটে রাস্তা!

নেসারুল হক খোকন

নেসারুল হক খোকন

প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দুই পাশে খাল কেটে রাস্তা!

প্রতীকী ছবি

দুই পাশে খালের মতো গভীর গর্ত করে মাটি তুলে রাস্তা বড় করছেন ঠিকাদার। দেখলে যে কেউ মনে করবে দুই পাশে খালের ডিজাইন করে রাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছে। আসলে দূর থেকে মাটি আনার খরচ কমিয়ে সরকারি টাকা লুটপাটের মহাআয়োজন করছে ঠিকাদার। এর সঙ্গে যুক্ত আছে এলজিইডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও। প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি টাকার এই কাজ বাস্তবায়নের পর আগামী বর্ষায় ধসে পড়ার আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী। দরপত্র সিডিউলে রাস্তা থেকে ১২ ফুট দূর থেকে মাটি আনার কথা থাকলেও সেটি মানা হচ্ছে না। রাস্তাকে বড় ধরনের ঝুঁকিতে ফেলে এভাবে রাস্তা নির্মাণ করলেও রহস্যজনক কারণে দায়িত্বরত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নীরব রয়েছেন।

এদিকে এ বিষয়ে তদারকির প্রধান দায়িত্বে থাকা উপজেলা প্রকৌশলী বলছেন, নিয়ম না মেনে মাটি ভরাট করছে ঠিকাদার। আবার ঠিকাদার বলছে, প্রকৌশলী যেভাবে বলেছেন সেভাবে মাটি কাটা হচ্ছে। এছাড়া বিল ছাড় করার তথ্য নিয়েও জটিলতা দেখা দিয়েছে। প্রকৌশলী বলছেন, প্রায় দেড় কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে। কিন্তু ঠিকাদারের দাবি-তিনি কোনো টাকা পাননি। তাকে বলা হয়েছে ফান্ড নেই।

কম খরচে রাস্তা নির্মাণের এই চিত্র দেখা যায় সুনামগঞ্জের দূর্গম তাহিরপুর উপজেলায়। স্থানীয় আনন্দবাজার থেকে ভিন্নাকুলি পর্যন্ত ২৭শ’ মিটার পর্যন্ত সড়ক নির্মাণে চলছে লুটপাটের এই আয়োজন। ব্যয়বহুল এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এলজিইডি। হাওড় এলাকায় উড়াল সড়ক ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় কাজটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এলজিইডির তাহিরপুর উপজেলা প্রকৌশলী মো. জাহিদুল ইসলাম কাজটি তদারকি করছেন। অথচ এই কর্মকর্তার সামনেই সরকারি টাকা তছরুপের মহাআয়োজন সম্পন্ন হচ্ছে।

চাঞ্চল্যকর তথ্য হচ্ছে, বাস্তবায়িত প্রকল্পের পাশে সাইনবোর্ডে কাজ শুরুর তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে গত বছরের ২৪ জুন। অথচ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মালিক কৃত্তিবাস দাস নিজেই রোববার যুগান্তরকে বলেন, দুই থেকে আড়াই মাস আগে তারা কাজ শুরু করেছেন। এই ঠিকাদার বলেন, ‘আমার কি দোষ? ইঞ্জিনিয়ার যেখান থেকে মাটি কাটতে বলেছে আমি সেখান থেইে মাটি কেটে রাস্তা বানিয়েছি। প্রতিদিনইতো সাইটে ইঞ্জিনিয়াররা এসে কাজের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করছেন। কত টাকা বিল পেয়েছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত এক টাকাও বিল পাইনি। বিল জমা দিয়েছি। আমাকে বলা হয়েছে ফান্ড নেই।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলজিইডির তাহিরপুর উপজেলায় কর্মরত একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী যুগান্তরকে বলেন, ‘ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মালিক সম্ভবত উপজেলা ইঞ্জিনিয়ার জাহিদুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ কেউ। এ বিষয়ে ওয়ার্ক অ্যাসিসটেন্টরা বার বার কাজ বন্ধ করার চেষ্টা করলেও স্যার বাধা দিয়েছেন। গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে এভাবে কোনো কাজ করতে দেখা যায়নি। এটা সম্ভব হচ্ছে একমাত্র জাহিদুল ইসলামের কারণে।’

জানতে চাইলে জাহিদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘মাটি কাটার কাজটি সঠিকভাবে করেনি ঠিকাদার। রাস্তার পাশ থেকে মাটি কাটায় সড়কটি খাড়া হয়ে আছে। আমি ঠিকাদারকে বলেছি এটা।’ বর্ষায় রাস্তা টিকবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রাস্তা টিকবে। হাওড়াঞ্চল হলেও রাস্তার পাশে ঢেউ হয় না!’ বরাদ্দ কত জানতে চাইলে বলেন, সাড়ে ১৬ কোটি টাকা না মনে হয়, আরও কম। দুটি প্যাকেজে ভাগ করে টাকা বরাদ্দ হয়েছে।’ অথচ নির্মাণাধীন সড়কের পাশে উন্মুক্ত সাইবোর্ডে প্রকল্পের নামসহ বরাদ্দের বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও উপজেলা প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম প্রতিবেদককে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করেন। কত টাকা বিল দিয়েছেন জানতে চাইলে বলেন, এক থেকে দেড় কোটি টাকা বিল পরিশোধ করা হয়েছে। অথচ ঠিকাদার নিজেই বলেছেন তারা কোনো বিল পাননি।

আলোচ্য দরপত্রের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, কাজের মধ্যে মাটি ভরাটের পাশাপাশি সড়কটিকে পাকা করারও সংস্থান রাখা হয়। স্থানীয় আনন্দবাজার থেকে লাউড়েরঘর পর্যন্ত ২৭শ’ মিটার রাস্তার সংস্থান রয়েছে। এ ছাড়াও ৭৫ মিটার লম্বা আরসিসি ব্রিজ ১টি, ১৩ দশমিক ২০ মিটার লম্বা আরসিসি ব্রিজ ১টি, ২৫ মিটার লম্বা পিএসসি ব্রিজ একটি। ১২ ফুট পাকা সড়ক ২৪ ফুটে করার কথা বলা আছে সিডিউলে। উন্নতি করতে দরপত্র আহ্বান করা হয়। সিডিউল অনুযায়ী রাস্তার মাটির কাজটি ঠিকাদারের নিজ খরচে সংগ্রহ করার কথা। এ কারণে স্থানীয় প্রকৌশলীর তদারকি ছাড়াই নিয়মবহির্ভূতভাবে নির্মাণাধীন রাস্তার গা ঘেঁসেই খালের মতো করে মাটি তুলে রাস্তা বানাতে দেখা গেছে। এ ছাড়াও কাজের গতি খুবই কম। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এই কাজ সম্পন্ন করা যাবে না।

কাজের বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন প্রকৌশলী যুগান্তরকে বলেন, উপজেলা প্রকৌশলী তদারকির দায়িত্বে থাকাবস্থায় এমন কাজ কিভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে মাথায় ধরে না। যেমন ঠিকাদার, তেমন তার প্রকৌশলী। কোনো সুস্থ মানুষ এভাবে পাশ থেকে মাটি কেটে রাস্তা বড় করতে পারে না। উভয়েই অনভিজ্ঞ। সরকারি স্বার্থ রক্ষায় জরুরিভিত্তিতে এই কাজ তদন্ত করে অর্থ ছাড় বন্ধ করা উচিত।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, কিশোরগঞ্জের ‘মেসার্স চ্যালেঞ্জার অ্যান্ড ভাটিবাংলা’ নামক দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে কাজটি সম্পন্ন করছে। এই কাজের চুক্তিমূল্য ধরা হয় ১৬ কোটি ৪৫ লাখ ৫২ হাজার ৩৯১ টাকা। গত বছরের ২৪ জুন এই সড়ক প্রশস্ত করার কাজ শুরু হয়। আগামী ১১ ফেব্রুয়ারি কাজটি শেষ করার কথা। কিন্তু নির্ধারিত এই সময়ে মাটি ভরাটের কাজও শেষ করতে পারেনি যৌথ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম