নেই মুক্তিযোদ্ধার সনদ। সনদ জমা না দিয়েই চাকরি করেছেন বহাল তবিয়তে। সনদের পরিবর্তে জমা দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রত্যয়নপত্র। অথচ সেটিও জাল। কিন্তু এসব জাল কাগজপত্রের ওপর ভর করে তিনি পুরো চাকরিজীবন পার করেন। উলটো মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অতিরিক্ত আরও দুই বছর চাকরি করতে চান। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। অবিশ্বাস্য হলেও তিনি তার পক্ষে রায় নিতেও সক্ষম হন। কিন্তু সুবিধা পাওয়ার শর্ত হিসাবে মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র যাচাইয়ের শর্তে আটকে যান তিনি। গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। এতেই শেষমেশ ফেঁসে যান তিনি। এখানেই শেষ নয়-চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পরও নিয়মবহির্ভূতভাবে দীর্ঘসময় সরকারি বাসাও দখলে রেখেছিলেন। আলোচিত এই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তার নাম মো. মজিবর রহমান। তিনি ছিলেন ডাক, টেলিযোগাযোগ, বিজ্ঞান, তথ্য ও প্রযুক্তি (পিটিএসটি) অডিট অধিদপ্তরের সাবেক অডিটর। ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও আর্থিক সুবিধা নিতে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছন তিনি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার পর মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে চিঠি দিয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে।
সূত্র বলছে, চাকরিতে আবেদনের শুরুতেই তিনি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে উল্লেখ করেন। তবে যোগদানকাল থেকে অবসর গ্রহণ পর্যন্ত কখনোই মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেখাতে পারেননি। সার্ভিস বইয়ে ৩ নম্বর পৃষ্ঠাসহ কোথাও তিনি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে উল্লেখ করেননি। পরবর্তী সময়ে অবসরে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় অতিরিক্ত দুই বছরের চাকরির সব সুবিধা ভোগের দাবি করে বসেন। এ সময় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি জাল প্রত্যয়নপত্রও জমা দেন তিনি। পরে বিষয়টি নজরে আনলে মজিবর রহমানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করে মুক্তিযদ্ধ মন্ত্রণালয়। কিন্তু আজ অবধি তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি অডিট অধিদপ্তর।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মো. মজিবর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘চাকরির ইন্টারভিউ চলাকালে আমি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলে সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করেছিলাম। তখন একটি প্রত্যয়নপত্র দিয়ে বলেছিল পরবর্তী সময়ে সার্টিফিকেট প্রস্তুত হলে দেবে। কিন্তু পরে আর আনতে পারিনি। ওইভাবেই চাকরি করেছি। পরবর্তী সময়ে আবেদন করলেও আমার ভাই বিএনপি নেতা হওয়ায় আওয়ামী লীগ সরকার আমাকে সার্টিফিকেট দেয়নি।’
উল্লেখ্য, ১৯৭৯ সালের ২ জুলাই জুনিয়র অডিটর হিসাবে চাকরিতে যোগদান করেন মো. মজিবর রহমান। তিনি ২০০৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ৫৭ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ায় এলপিআর-এ যান। এ সময় সব আর্থিক সুবিধাও গ্রহণ করেন। এলপিআর ভোগকালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২০০৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরিকাল দুই বছর বাড়ায়। ২০১০ সালের ৭ জানুয়ারি মজিবর রহমান নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আরও দুই বছর চাকরি করার আবেদন করেন। আবেদনপত্রের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধার একটি প্রত্যয়নপত্র জমা দেন। মজিবর রহমানের বাড়ি বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার সুজনকাঠি গ্রামে।
মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সুবিধা দাবির পর তার মুক্তিযোদ্ধার প্রত্যয়নপত্রটি সঠিক কি না, যাচাইয়ের জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠান তৎকালীন নিরীক্ষা ও হিসাবরক্ষণ অফিসার শেখ মোবাশ্বের হোসেন। এ চিঠির জবাবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সিনিয়র সহকারী সচিব আব্দুল লতিফ মোল্লা অডিট অধিদপ্তরকে জানান, মো. মজিবর রহমানের প্রত্যয়নপত্রটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয়নি। প্রত্যয়নপত্রটির গেজেট নম্বর, সনদপত্র প্রাপ্তির আবেদন নম্বর ও তারিখ এই মন্ত্রণালয়ের নয়। পত্রটি পরীক্ষান্তে দেখা যায়, পত্রে বর্ণিত স্বাক্ষর নিম্নস্বাক্ষরকারীর নয়। তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধা গেজেট ও মুক্তিবার্তা যাচাই করে তার নাম গেজেট ও মুক্তিবার্তায় পাওয়া যায়নি। এতে প্রতীয়মান হয়, মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে প্রত্যয়নপত্রটি ভুয়া।
এদিকে প্রত্যয়নপত্র দাখিলকারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে পিটিএসটি অডিট অধিদপ্তরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
পিটিএসটি অডিট অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, মজিবর রহমান ১৯৭৭ সালের ১৬ নভেম্বর চাকরিতে নিয়োগের আবেদনপত্রের ক্রমিক নম্বর ১০-এ নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে উল্লেখ করেন। তার মুক্তিযোদ্ধার মূল সার্টিফিকেট কেন্দ্রীয় সংসদে জমা আছে বলেও সেখানে উল্লেখ করেন। একই বছরের ২ মে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলে তার সনদ জমা রয়েছে উল্লেখ করে চাকরির জন্য সুপারিশ করা হয়। কিন্তু মজিবর রহমানের নিয়োগপত্র (স্মারক নং প্রশাসন-১৭৯/সংগ্রহ-১২/ সংস্থাপন/ ৪১৩৯০, তাং-২৯/০৬/১৯৭৯ খ্রি.) সংক্রান্ত নথিতে তার মুক্তিযোদ্ধাসংক্রান্ত কোনো প্রমাণপত্র নেই।
এছাড়া মজিবর রহমানের সনদপত্র যাচাইকালে চাকরিতে প্রবেশকালে ন্যূনতম যোগ্যতা এইচএসসি হলেও সনদপত্রে বেশকিছু অসংগতি দেখা গেছে। তিনি এসএসসি পাশ করছেন ১৯৭০ সালে এবং এইচএসসি পাশ করছেন ১৯৭২ সালে। কিন্তু এইচএসসির রেজিস্ট্রেশন নম্বর ৫৩১২/১৯৬৭-১৯৬৮; যা থেকে প্রতীয়মান হয়, তিনি এসএসসি পাশের আগেই এইচএসসির রেজিস্ট্রেশন করেছেন। এখানে বড় ধরনের বিভ্রান্তি এবং একধরনের জালজালিয়াতির আলামত স্পষ্ট। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এটিও তদন্তের দাবি রাখে। একজন ব্যক্তি ১৯৭০ সালে এসএসসি পাশ করে কীভাবে ১৯৬৮ সালে এইচএসসি পাশ করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মজিবর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘ওই সময় সার্টিফিকেট (সনদপত্র) যারা দিয়েছেন, তারা বলতে পারবেন। এ সম্পর্কে আমার জানা নেই।’
অবসরে যাওয়ার পরও দীর্ঘসময় সরকারি বাসায় কীভাবে থাকলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি তো জোর করে ছিলাম না। অফিস আমাকে কিছু বলেনি।’
মজিবর রহমানের ঘটনা তদন্তে ২০২০ সালের ২৭ জুলাই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে পিটিএসটি অডিট অধিদপ্তর। তদন্ত কমিটি তার কাছে বারবার মুক্তিযোদ্ধা সনদ চাইলেও তিনি দেখাতে পারেননি। এ কারণে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণের মতামত দেয় তদন্ত কমিটি। পাশাপাশি ২০১০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ৮ বছর ১ মাস ২৩ দিন অনুমোদন ছাড়াই বসবাসের জন্য স্ট্যান্ডার্ড রেটে বাসা ভাড়া এবং সরকারি পাওনা আদায় করারও পরমর্শ দেয় কমিটি। এতকিছুর পরও মজিবর রহমান ২০২১ সালে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল-১ ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অতিরিক্ত দুই বছর চাকরিকাল গণনাসহ পেনশন সুবিধাপ্রাপ্তির জন্য মামলা দায়ের করেন (মামলা নম্বর-৭২)। তার পক্ষে রায়ও হয়। ২০২৪ সালের ৪ মে আদালতের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে পেনশন সুবিধাদি দাবি করাসহ মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অতিরিক্ত দুই বছর চাকরিকাল গণনা করে পিআরএল মঞ্জুরির আবেদন করেন মজিবর রহমান।
এ প্রসঙ্গে অডিট ডাইরেক্টর পলাশ বাগচী যুগান্তরকে বলেন, ‘মামলায় মজিবর রহমান একটি রায় পেয়েছেন। রায়ে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। তবে আদেশে বলা আছে, সনদপত্র (সার্টিফিকেট) যাচাই সাপেক্ষে তিনি সুবিধা পাবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো-বারবার তাগিদ দেওয়া হলেও তিনি সনদপত্র দেখাতে পারেননি। একটি প্রত্যয়নপত্র দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটিও জাল বলে প্রমাণিত হয়েছে। ফলে আমরা এসব তথ্যপ্রমাণ যুক্ত করে আপিল করার জন্য আইনজীবী নিয়োগের চিঠি দিয়েছি।’