রাজধানীর ক্যানসার ও কিডনি হাসপাতাল
অল্প বরাদ্দের প্রভাব রোগীর খাবারে
জাহিদ হাসান
প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ক্যানসার ও কিডনি রোগীদের চিকিৎসায় রাজধানীর মহাখালী ও শেরেবাংলা নগরে দুটি বিশেষায়িত হাসপাতাল রয়েছে সরকারের। তবে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাধীন রোগীদের খাবারের জন্য চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ খুবই অপ্রতুল বলছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে রোগীদের ক্যালরি মেপে, বয়স, ওজন ও রোগের ধরন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় খাবার দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি আইসিইউ এবং এইচডিইউ ইউনিটেও দেওয়া হচ্ছে সাধারণ রোগীদের মতো খাবার। দুটি হাসপাতালের কোনোটিতেই নেই পুষ্টিবিদ। নামমাত্র ডায়েটিশিয়ান থাকলেও এ ব্যাপারে নজরদারির ঘাটতি আছে। এমনকি বাণিজ্য শিক্ষায় স্নাতক পাশ করে ক্যানসার হাসপাতালের ডায়েটিশিয়ান এবং কিডনি হাসপাতালের সহকারী ডায়েটিশিয়ান সমাজ বিজ্ঞানে স্নাতক পাশ করে দায়িত্ব পালন করছেন।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগীর খাবার ও পথ্য চিকিৎসার একটি অপরিহার্য অংশ। এ ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটলে রোগ সারতে দেরি হয়। আবার রোগীর খরচও বাড়ে। অন্যদিকে হাসপাতাল দুটিতে চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের অভিযোগ-মোটা চালের ভাত, পানির মতো পাতলা ডাল ও নামকাওয়াস্তে স্বাদহীন তরকারি খেতে দেওয়া হয়। অনেক রোগী তা খেতে পারেন না।
এমন অভিযোগের বিষয়ে ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসা কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানিয়েছেন, করোনা মহামারির দুই বছর আগে সরকারি হাসপাতালে প্রত্যেক রোগীর জন্য দৈনিক বরাদ্দ ছিল ১২৫ টাকা। মহামারি শুরুর পর ২০২২ সালে বরাদ্দ বাড়িয়ে ১৭৫ টাকা করা হয়। এর মধ্যে ১৫ শতাংশ ভ্যাট কেটে রাখা হয়।
খাবার বণ্টনের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের স্টুয়ার্ড, বাবুর্চিরা বলেন, রোগীপ্রতি দৈনিক বরাদ্দকৃত ১৭৫ টাকার মধ্যে ১৫ শতাংশ (২৬ টাকা ২৫ পয়সা) ভ্যাট কাটার পর ১৪৮ টাকা ৭৫ পয়সা থাকে। এই টাকায় বিকালের নাশতাসহ মোট চার বেলার খাবার দেওয়া হয়। অর্থাৎ প্রতিবেলা খাবারের জন্য বরাদ্দ ৩৭ টাকা ১৮ পয়সা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে এত কম টাকায় রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী খাবার সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না।
জাতীয় ক্যানসার হাসপাতালের খাদ্যতালিকায় দেখা যায় সকালে ৪ পিস পাউরুটি, একটা সাগর কলা, ২০০ মিলিমিটার পাস্তুরিত দুধ ও একটা সেদ্ধ ডিম রয়েছে। বিকালে এক প্যাকেট বিস্কুট ও একটা কলা রয়েছে। দুপুর ও রাতের খাবারে ৩৬০ গ্রাম পায়জাম চালের ভাত, ৫৫ গ্রাম করে মাছ (রুই, মৃগেল) বা ব্রয়লার মাংসের তরকারি। মাছ ও মাংসের পিসের সঙ্গে মিষ্টি কুমড়া, কাঁচা পেপে, লাউ, ফুলকপি, চালকুমড়া, বাধাকপি বা পুইশাক যে কোনো একটি। তবে রোগীদের অভিযোগ তালিকা দীর্ঘ হলেও দিনশেষে খাবার প্লেটে তেমন কিছু জোটে না।
গলায় সমস্যা নিয়ে ক্যানসার হাসপাতালের পঞ্চম তলায় ১নং মহিলা ওয়ার্ডের ‘বি ৩৭ নম্বর’ শয্যায় ভর্তি আছেন রিজিয়া বেগম (৭০)। বুধবার দুপুরে তার মেয়ে মায়ের জন্য হাসপাতাল থেকে দেওয়া খাবার নিচ্ছিলেন। কী খাবার দিয়েছে দেখতে চাইলে তিনি জানান এক প্লেট ভাতের সঙ্গে প্রায় গলে যাওয়া পেপের টুকরা মিশ্রিত সামান্য ডিমের ঝোল ও পানির মতো পাতলা ডাল।
একই ওয়ার্ডের ৫১ নম্বর শয্যায় নাকে নল পড়ানো অবস্থায় শুয়ে থাকতে দেখা যায় আরেক রোগী নাজমা বেগমকে। গত শনিবার মুখের ভেতরে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। তার মেয়ে তানিয়া বলেন, বছরদেড়েক আগে মাকে এখানে একবার অস্ত্রোপচার করা হয়। ফের অসুস্থ হওয়ায় ৮ ডিসেম্বর ভর্তি করেছি। মা হাসপাতালের দুপুর ও রাতের খাবার খেতে পারে না। কারণ মোটা চালের ভাত বেশ শক্ত। সকালে দেওয়া ডিম, দুধ ও কলা খাওয়াই। অস্ত্রোপচারের পর বাইরে থেকে খাবার এনে ব্লেন্ড করে খাওয়াচ্ছি।
৫৬ নম্বর বিছানায় ভর্তি ৩৪ মাস বয়সি শিশুর কিডনিতে টিউমার থেকে ক্যানসার ধরা পড়েছে। ইতোমধ্যে ২১টি থেরাপি সম্পন্ন হয়েছে। চিকিৎসক আরও ৫টি লিখেছেন। শিশুটির মা জুলি আক্তার বলেন, এখানে ছোট ও বড়দের জন্য একই খাবার। শিশুরা হাসপাতালের খাবার খেতে চায় না বলে বাইরে থেকে রান্না করে আনি। বাইরে পরিচিত এক বাসায় প্রতিবার ভাত ও তরকারি রান্নার জন্য ৪০ টাকা করে দিতে হয়।
ক্যানসার হাসপাতালের ‘ডায়েটেশিয়ান’ ছামিউল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, তিনি বাণিজ্য শিক্ষায় স্নাতক। স্টুয়ার্ড হিসাবে কাজ করতেন সরকারের অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে। পদোন্নতি পেয়ে এখানে এসেছেন। পুষ্টি বিষয়ে এক সপ্তাহের প্রশিক্ষণ আছে তার। ক্যালরি মাপাসহ অন্যান্য দায়িত্ব কীভাবে পালন করছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি চর্চার বিষয়, সমস্যা হচ্ছে না।
বৃহস্পতিবার জাতীয় কিডনি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের তিন নম্বর ওয়ার্ডে ৩নং শয্যায় বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন নাসিমা বেগম (৫০)। প্লেটে এক পিস ব্রয়লার মুরগির মাংসের সঙ্গে কয়েক টুকরো পেপের ঝোল তরকারি ছিল। জানতে চাইলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার মেয়ে তাহমিনা বলেন, ভাত-তরকারির সঙ্গে ডালও দেয়। কিন্তু কিডনি রোগীর ডাল খাওয়া নিষেধ তাই নিইনি।
নিষেধ হওয়ার পরও রোগীর খাদ্য তালিকায় ডাল থাকার কারণ সম্পর্কে হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, গুরুতর কিডনি রোগীদের ডাল খাওয়া নিষেধ। কিন্তু নিউরোলজি ও ডায়াবেটিসসহ কিছু রোগী ভর্তি থাকে যাদের জন্য ডাল রাখা হয়েছে। তাছাড়া রোগী না খেলে অ্যাটেনডেন্টরা খেয়ে থাকেন।
হাসপাতালের স্টুয়ার্ড মাসুদ করিম ও স্যানেটারি ইন্সপেক্টর সুফী আব্দুল হুমায়ন কবির যুগান্তরকে বলেন, রোগীপ্রতি দৈনিক বরাদ্দকৃত টাকায় কোনোভাবেই চাহিদা অনুপাতে খাবার দেওয়া সম্ভব হয় না। কারণ ভর্তি সাধারণ রোগীদের সকালের নাস্তায় ১৪০ গ্রাম পাউরুটি, ২টা ডিম ও একটা কলার পেছনে ৫২ টাকা ৮ পয়সা ব্যয় হয়ে যায়। দুপুরে ৫৫ টাকা ১৩ পয়সা, বিকালের নাস্তায় ৬ টাকা ১৭ পয়সা, রাতে ৫৭ টাকা ৮০ পয়সা এবং মসলা ক্রয় বাবদ ৩ টাকা ৮০ পয়সাসহ মোট ১৭৫ টাকা ব্যয় হয়।
সকালে ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য ৫৪ টাকা ১৯ পয়সা, শিশু রোগীদের ৫২ টাকা ৮ পয়সা, কিডনি রোগীদের ৫২ টাকা ৩ পয়সা এবং যাদের বেশি প্রোটিন লাগে তাদের সকালের নাস্তায় ৬৬ টাকা ৩৬ পয়সা ব্যয় হয়। সকালে খরচ বেশি হওয়ায় বাকি সময়ের খাবারের টাকার সঙ্গে সমন্বয় করতে হয়। এতে দুপুর, বিকাল ও রাতের খাবার চাহিদা অনুপাতে খাবার দেওয়া কঠিন হয়।