আলীকদমে আওয়ামী লীগ নেতা অংশোথোয়াইর দুর্নীতির সাম্রাজ্য
জমি দখল করেই শতকোটি টাকার মালিক
মুহাম্মদ আবুল কাশেম
প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বান্দরবানের আলীকদম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অংশোথোয়াই মার্মা রাজনৈতিক পরিচয়কে পুঁজি করে দুর্নীতির অপ্রতিরোধ্য সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। তার অবৈধ কর্মকাণ্ডে শুধু প্রশাসন নয়, সাধারণ মানুষও অসহায় হয়ে পড়েছে। এক দশকেরও বেশি সময় তিনি প্রভাব বিস্তার করে চলেছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নামে-বেনামে অংশোথোয়াই শতকোটি টাকার সম্পত্তির মালিক বনে গেছেন। বন বিভাগের জমি জবরদখল, বিলাসবহুল রিসোর্ট, মৎস্য প্রকল্প, করাত কল, রাবার বাগানসহ বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান তার অপকর্মের প্রতীক। তার ক্ষমতার প্রভাব এতটাই ব্যাপক যে, তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পান না। মুখ খুললেই নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। এমনকি তার সমালোচনা করে অনেক নিরপরাধ ব্যক্তি মামলার আসামি হয়েছেন। বাসিন্দাদের অভিযোগ, দীর্ঘ ১৬ বছর মাফিয়া কায়দায় উপজেলায় তিনি নিজের একচ্ছত্র প্রভাব ধরে রেখেছেন। তার দুর্নীতির চিত্র শুধু সম্পদ দখল বা বন উজাড়ে সীমাবদ্ধ নয়; পর্যটন খাতে সিন্ডিকেট পরিচালনা এবং সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে উন্নয়নের নামে লোকদেখানো প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘটনাও রয়েছে। একটিমাত্র সড়কের জন্য বিভিন্ন নামে টেন্ডার বাগিয়ে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন একাধিকবার সরকারি অর্থ।
রাজনীতির মুখোশে দুর্নীতির সাম্রাজ্য : ছাত্রলীগের মধ্য দিয়ে অংশোথোয়াই মার্মার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু। তার বাবা ছিলেন বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি আলীকদম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। আর এ পদ ব্যবহার করে তিনি একের পর এক দুর্নীতির ফাঁদ পাতেন। মংচাপাড়া এলাকায় শত শত একর জমি দখল করে সেগুন ও রাবার বাগান করেছেন। এ বিষয়ে ভুক্তভোগীরা বান্দরবান জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাননি। ৩ নম্বর নয়াপাড়া ইউনিয়নের মুসলিমপাড়ায় অংশোথোয়াই বিশাল মৎস্য প্রকল্প গড়ে তুলেছেন। প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বনের গাছপালা কেটে প্রকল্পটি করেছেন।
আধিপত্য বিস্তার করে আত্মীয়স্বজনের জমি দখল করে সেখানে অংশোথোয়াই ‘দ্য দামতুয়া ইন’ নামে বিলাসবহুল রিসোর্ট গড়ে তুলেছেন। এ রিসোর্টের আড়ালে তিনি নানা ধরনের অবৈধ ব্যবসা পরিচালনা করছেন। আলীকদম উপজেলার সরকারি রেস্টহাউজটিও রয়েছে তার দখলে। সেখানে ‘দ্য দামতুয়া ইন’- এর আরেকটি শাখা করেছেন। ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠিত তার কোম্পানি ‘দ্য দামতুয়া ফুডস’-এর অধীনে আলীকদম বাজারে বনফুল অ্যান্ড কোং-এর শোরুম চালু করেন। স্থানীয়দের অভিযোগ-এ ব্যবসাগুলো চালানোর পেছনে সরকারি সম্পত্তি দখল এবং সরকারি তহবিল নয়ছয়ের কৌশল রয়েছে।
পর্যটন খাতেও দুর্নীতি ও দখলদারি : পর্যটন খাতে অংশোথোয়াইয়ের দখলদারির চিত্র ভয়াবহ। আলীকদম উপজেলার আবাসিক বাজার এলাকার কয়েকজন পর্যটন ব্যবসায়ী জানান, আলীকদমের মারাইনতং পাহাড়ের প্রায় ১১০ একর জমি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নামে তিনি দখল করে রেখেছেন। একইভাবে আলী সুড়ঙ্গসংলগ্ন বন বিভাগের জমিতে গড়ে তুলেছেন অবৈধ কটেজ। স্থানীয়দের অভিযোগ-মারাইনতং পাহাড়ে যাতায়াতে নির্মিত আরসিসি রাস্তা তার লুটপাটের উদাহরণ। বর্তমানে ২ নম্বর চৈক্ষ্যং ইউনিয়নে তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প। এসব প্রকল্পের কাজের গুণগত মান নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে রয়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া।
উন্নয়নের নামে ব্যক্তিগত স্বার্থে প্রকল্প বাস্তবায়ন : অংশোথোয়াই মার্মার প্রভাবে উপজেলায় উন্নয়ন প্রকল্পগুলো মূলত তার ব্যক্তিগত স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে। ২ নম্বর চৈক্ষ্যং ইউনিয়নে এলজিইডির আওতায় পরিচালিত প্রকল্পগুলোর বেশির ভাগই তার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে মেজর জামানপাড়া সড়ক কার্পেটিং, মহ্লাপাড়া সড়ক নির্মাণ এবং মারাইনতং পাহাড়ের সড়ক।
অভিযোগ-আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত আলীকদম থানায় হওয়া মামলাগুলোর বেশির ভাগই তার নির্দেশে হয়েছে। এমনকি স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিকও তার অপকর্মে সহযোগিতা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
জাতীয় পুরস্কারেও দুর্নীতির ছাপ : ২০২১ সালে অংশোথোয়াই মার্মা জাতীয় যুব উদ্যোক্তা পুরস্কার পান। তবে স্থানীয়দের দাবি-তার কার্যক্রম এ পুরস্কারের উপযুক্ত ছিল না। এ বিষয়ে তার নিকটাত্মীয় উথোয়াই মার্মা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে অভিযোগ দেন।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমনেও কোটি কোটি টাকা ব্যয় : বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, পার্বত্য তিন জেলায় স্থানীয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে অংশোথোয়াই মার্মা গোপনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেছেন। এ সময় নানা বিষোদ্গার করে তিনি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। তার অবৈধ কার্যক্রমের সুষ্ঠু তদন্ত এবং তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
বান্দরবান জেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেলাভিত্তিক ছাত্র প্রতিনিধি আসিফ ইকবাল জানান, আওয়ামী লীগ ও ফ্যাসিবাদের দোসরদের আমরা ছাড়ব না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় অর্থ জোগান দিয়ে অংশোথোয়াই মার্মা আলোচিত হন। এ ব্যাপারে আমরা অবগত ছিলাম না। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত মোতাবেক তার বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। অংশোথোয়াই মার্মার বনের জমি জবরদখল ও স্থাপনা নির্মাণ করে রিসোর্ট কীভাবে করা হয়েছে-জানতে চাইলে বান্দরবান জেলার তৈন রেঞ্জ কর্মকর্তা খন্দকার আরিফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আমরা খোঁজ নিচ্ছি। বনের জমি জবরদখল করে স্থাপনা নির্মাণ করা হলে আইনগত ব্যবস্থা নেব। অভিযোগের বিষয়ে অংশোথোয়াই মার্মার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সিংহভাগই মিথ্যা। দুর্নীতির বিষয়ে দুদক তাকে চিঠি দিয়েছে বলে তিনি স্বীকার করেন। আওয়ামী লীগের পদপদবি ব্যবহার করে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে যেসব সম্পদ অর্জন করেছেন, সেসবের আয়কর ঠিকমতো আছে কি না-জানতে চাইলে ‘এটা তদারকি করার জন্য এদেশে একাধিক সংস্থা আছে। তারা দেখুক’ বলে তিনি ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।