সাড়ে ১০ কোটি টাকার প্রস্তাব ৪০ কর্মকর্তার জন্য
স্ট্রিটলাইট দেখতে বিদেশ সফর
এডিবির অর্থায়নে রোহিঙ্গা উন্নয়ন প্রকল্প: পরিকল্পনা কমিশনের ভেটো; বাতিল হচ্ছে প্রস্তাব; কমছে পরামর্শক, গাড়ি কেনাসহ অন্যান্য খাতের ব্যয়
থামছেই না অহেতুক প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ সফরের প্রস্তাব। পতিত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে শুরু হওয়া এই অপকর্ম এখনও অব্যাহত আছে। এবার রোহিঙ্গা ও স্থানীয় বাংলাদেশিদের উন্নয়নের একটি প্রকল্পে স্ট্রিটলাইট (সড়ক বাতি) ও সড়ক উন্নয়ন দেখতে বিদেশ যেতে চান ৪০ কর্মকর্তা। এজন্য চাওয়া হয়েছে ১০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ২ কোটি ২০ লাখ এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ ও অনুদানের অর্থ থেকে ৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা খরচের প্রস্তাব দিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। এটি অনুমোদন পেলে প্রত্যেক কর্মকর্তার পেছনে ব্যয় হবে প্রায় ২৬ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। ‘ইন্টিগ্রেটেড সার্ভিস অ্যান্ড লাইভলিহুড ফর ডিসপ্লেসড পিপল ফ্রম মিয়ানমার অ্যান্ড হোস্ট কান্ট্রিজ ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট (এলজিইডি পার্ট)’ শীর্ষক নতুন প্রকল্পে এমন প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু দেশের চলমান আর্থিক সংকটে প্রকল্পের অর্থে বিদেশ সফরে কড়াকড়ির আরোপ করেছে সরকার। এজন্য এই প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন তুলে ভেটো দেয় পরিকল্পনা কমিশন। ১০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় বিদেশ প্রশিক্ষণ, পরামর্শক ও দামি গাড়িসহ বিভিন্ন খাতের ব্যয়ের বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। অবশেষে এই খাতের ব্যয় বাতিল এবং পরামর্শকসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় কমানোর সুপারিশ দিয়ে প্রস্তাব ফেরত দেওয়া হচ্ছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ যুগান্তরকে বলেন, রোহিঙ্গাদের উন্নয়নে নেওয়া এ ধরনের একটি প্রকল্পে কেন বিদেশ সফরের প্রস্তাব থাকবে সেটিই বড় প্রশ্ন। কেননা এডিবি ঋণ ও অনুদান যাই দিক না কেন এটি সরকারের অর্থ। সেখানে যেসব কার্যক্রম করা হবে সেগুলো তেমন জটিল বা কঠিন কোনো কাজ নয়। তাহলে প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ সফরে অর্থ অপচয় কোনোভাবেই ঠিক নয়। এমন প্রস্তাব কেন দেওয়া হয়েছে এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের উচিত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে কঠোর ভাষায় ব্যাখ্যা চাওয়া। এছাড়া নির্মাণ কাজে যে বেশি বেশি ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে এ বিষয়ে কঠোরতা দরকার। রেট শিডিউলের সঙ্গে খুব ভালোভাবে মিলিয়ে দেখলে হয়তো এসব খাতে ব্যয় অনেক কমবে।
জানা গেছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ১২৩ কোটি, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ ১০০ কোটি এবং অনুদান থেকে ৩৮২ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। প্রক্রিয়াকরণ শেষে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে অনুমোদন পেলে জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ২০২৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে। প্রকল্পটি কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ এবং নোয়াখালীর হাতিয়া, কোম্পানিগঞ্জ, সুবর্ণচর এবং বেগমগঞ্জ উপজেলার বাস্তবায়ন করবে এলজিইডি।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) মো. ছায়েদুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, অনুদানের টাকা বলে যে কোনো খাতে ইচ্ছেমতো ব্যয় করা যায় না। আমরা পিইসি সভায় প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ সফরের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা নানা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত এ খাতের ব্যয় পুরোটাই বাতিলের পক্ষে মত দেওয়া হয়েছে। এছাড়া পরামর্শকসহ বিভিন্ন খাতের ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনতে বলা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন সব সময়ই অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে থাকে।
সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত প্রকল্পটির আওতায় মূল কার্যক্রম হলো-১২ হাজার ৫৮৭টি নতুন স্ট্রিট লাইট সরবরাহ ও স্থাপন এবং ২৮ দশমিক ৬৫ কিলোমিটার ইউনিয়ন সড়ক উন্নয়ন করা হবে। এছাড়া ৫৩ দশমিক ২২ কিলোমিটার গুরুত্বপূর্ণ গ্রাম সড়ক উন্নয়ন, ৬ দশমিক ২৮ কিলোমিটার অভ্যন্তরীণ সড়ক উন্নয়ন, ২৪ দশমিক ৬০ কিলোমিটার উপজেলা-ইউনিয়নও গ্রাম সড়ক পুনর্বাসন এবং ৮২ মিটার ব্রিজ নির্মান-পুনর্নির্মাণ ও প্রশস্তকরণ করা হবে। আরও আছে ২৭৬ দশমিক ৫৩ মিটার কালভার্ট নির্মাণ বা পুনর্নির্মাণ, ৩টি খাদ্য সরবরাহ কেন্দ্র তৈরি, সাড়ে ৭ কিলোমিটার ন্যাচার বেজ পদ্ধতিতে ক্যাম্পের খাল পুনরুদ্ধার, ৬টি মালটিপারপাস সাইক্লোন শেল্টার, ২টি মালটিপারপাস কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ এবং ১৪ হাজারটি বিদ্যমান ও নতুন স্ট্রিট লাইটের অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে।
পিইসি সভা সূত্র জানায়, পরামর্শক খাতে ৪০ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয় প্রকল্পটিতে। এক্ষেত্রে পরামর্শকের সংখ্যা এবং এ খাতে প্রাক্কলিত ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় সভায়। এছাড়া প্রকল্পভুক্ত নির্মাণ কাজগুলো প্রাক্কলিত ব্যয় অধিক ধরা হয়েছে বলে পিইসি সভায় প্রশ্ন তোলে পরিকল্পনা কমিশন। সেই সঙ্গে একক দরের ভিত্তি সম্পর্কেও জানতে চাওয়া হয়। পাশাপাশি প্রকল্পের আওতায় ২টি পাজেরো গাড়ি, ৩টি ডাবল কেবিন পিকআপ এবং ১৮টি মোটরসাইকেল কেনার প্রস্তাব করা হয় সরকারি টাকায়। এসব যানবাহন কেনার যৌক্তিকতা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। এছাড়া বাড়ি ভাড়া, অন্যান্য ভাতা, আউটসোর্সিং, কন্টিনজেন্ট স্টাফ, ভ্রমণ, কাঁচামাল ও খুচরা জিনিসপত্র, কম্পিউটার ও অন্যান্য জিনিস, পেট্রোল, অয়েল, লুব্রিকেন্ট, যানবাহন মেরামত এবং অন্যান্য বিভিন্ন খাতে বেশি ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে বলে মনে করে পরিকল্পনা কমিশন। এসব খাতের ব্যয় কমাতে সুপারিশ দেওয়া হচ্ছে।