Logo
Logo
×

শেষ পাতা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

কান্না আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে ঢামেকের পরিবেশ

ফিরে দেখা ২০২৪

শিপন হাবীব

শিপন হাবীব

প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কান্না আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে ঢামেকের পরিবেশ

ছবি: সংগৃহীত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার কান্না-আর্তনাদে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ভেতর-বাহির একাকার। প্রতিমুহূর্তেই গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন শরীর-লাশ আসছে। হাসপাতালের বারান্দা, জরুরি বিভাগ, আশপাশের সব কক্ষে ছটফট করছিল শত শত অসহায় প্রাণ। তাদের বাঁচাতে আসা ছাত্র-জনতার ভিড়ও ছিল অনেক। চিকিৎসক-নার্সদের প্রতি সর্বোচ্চ অনুরোধ-প্রাণ বাঁচানোর আকুতি-মিনতি চলছেই। ওই সময় হতাহতদের রক্তে ভাসছে চারপাশ। প্রাণ বাঁচাতে সমন্বয়ক থেকে সাধারণ ছাত্র-জনতা, রক্ত দিচ্ছিলেন স্বেচ্ছায়। তখনও মর্গের ভেতর-বাইরে লাশের এক বীভৎস দৃশ্য। যত সময়-দিন যাচ্ছিল, হাসপাতালে হতাহতদের সংখ্যা বাড়ছিল। তখনও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা অসহযোগ কর্মসূচি চলছিল। সময়টা তখন আগস্টের শুরু।

সরকারি হিসাবে ১৮৬ জনের মৃত্যু হয়েছে ঢামেক হাসপাতালে। কিন্তু এ হিসাবের বিপরীতে হাসপাতালটিতে ৩০০ জনের বেশি মৃত্যু হয়ে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের ভাষ্য-অধিকাংশ লাশ ময়নাতদন্ত, তালিকাভুক্ত না করেই স্বজনরা নিয়ে গেছেন। এতে লাশের হিসাব কোনোক্রমেই মিলছে না। ১৭ থেকে ৩১ জুলাই ১০১ জন মারা যান। ৩ থেকে ৮ আগস্ট মারা যান ৮৬ জন। ২৯ এবং ৩১ জুলাই ৪ জনের মৃত্যু হয়। তাদের মধ্যে ৩ আগস্ট ১ জন, ৪ আগস্ট ১২ জন, ৫ আগস্ট ৪৬ জন এবং ৬ আগস্ট ২২ জনের মৃত্যু হয়। এছাড়া ৭ আগস্ট ১০ জন এবং ৮ আগস্ট ৫ জন মারা যান। অর্থাৎ ঢামেক হাসপাতালে ২৮৩ জনের মৃত্যু হয়।

জুলাই থেকেই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতাহত ছাত্র-জনতাকে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে আসা হচ্ছিল। ১ আগস্ট থেকে হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ৪ আগস্ট যখন অসহযোগ কর্মসূচি দেওয়া হয়, তখন রাজধানীসহ পুরো দেশেই ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় আওয়ামী সরকার। ওইদিন গুরুতর আহত অবস্থায় ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি হয় প্রায় ২০০ জন। তাদের মধ্যে অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ হয়। ওইদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ১২ জন। এর আগে ১৫ থেকে ৩১ জুলাই অন্তত ৪৫০ ছাত্র-জনতা হতাহত হয়ে হাসপাতালটিতে আসেন। মারা যান প্রায় ১০১ জন। ওই সময় এক দিনেই অর্থাৎ ১৮ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে আসা ২ জন সাংবাদিকসহ ৯ জন মারা যান। চিকিৎসা নিতে আসেন প্রায় ২ হাজার ছাত্র-জনতা। ওই সময় থেকেই ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ছাত্র-জনতার ওপর চড়া হয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীসহ অঙ্গ-সংগঠনের নেতারা। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের হুমকি দেওয়া হয়-আহতদের যেন যথাযথ চিকিৎসা না করা হয়। এর বিপরীতে ছাত্র-জনতাও অবস্থান নেয় হাসপাতালটিতে। হতাহতদের চিকিৎসায় সমন্বয়ক-ছাত্র-জনতা চিকিৎসায় হাসপাতালটিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। গড়ে তুলেন প্রতিরোধ।

১ আগস্ট থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ ছাত্রলীগ-যুবলীগের ক্যাডাররা হাসপাতাল চত্বরে অবস্থান নেয়। আহতদের চিকিৎসা যাতে না হয়, সেজন্য হাসপাতালের প্রবেশপথে বাধা দেয়। অপরদিকে ছাত্র-জনতা হাসপাতালের ভেতর-বারান্দায় অবস্থান নিয়ে হতাহতদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে লাগে। ১ থেকে ৫ আগস্ট হাসপাতালের জরুরি বিভাগসহ আশপাশে ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও পুলিশ বেশ কয়েকবার সাধারণ ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, গুলি চালায়। ওই অবস্থায় ৪ আগস্ট ২ শতাধিক ছাত্র-জনতাকে গুলিবিদ্ধসহ গুরুতর আহত অবস্থায় ঢামেক হাসপাতালে আনা হয়। ওইদিন হাসপাতালেই মৃত্যু হয় ১২ জনের। হাসপাতালজুড়ে তখন হাজারো ছাত্র-জনতা জড়ো হন। বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন ছাত্র-জনতা। লাশ নিয়ে মিছিল বের করেন কেউ কেউ। হাসপাতালের সামনে নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেন রক্ত সংগ্রহের বিশেষ কার্যক্রম। ওই সময় রক্তের অভাবে অনেকেই মারা যান।

জুলাইয়ের শেষের দিনগুলো থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আহতদের চিকিৎসায় দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক মো. মিশু আলী সুহাশকে। সহ-সমন্বয়ক মিশুসহ আরও অনেকে হাসপাতালটিতে অবস্থান নিয়ে হতাহতদের চিকিৎসা নিশ্চিতে কাজ করেছেন। মো. মিশু আলী সুহাশ যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি আজও ঘুমাতে পারি না। চোখের সামনে শত শত ছাত্র-জনতার লাশ ছিন্নভিন্ন শরীর পড়ে থাকতে দেখেছি। রক্তের জন্য মরছিল এক এক করে। গুলিবিদ্ধ ভাইদের মগজ বের হয়ে আসছিল। কারও পেটের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে ছিল। চোখের সামনে অনেকেই শহিদ হয়েছেন। ওই সময় আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও তাদের বাঁচাতে পারিনি। আমি ছাত্র-জনতাকে আরও সোচ্চার হওয়ার জন্য হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে মিছিলে বের হয়েছি। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও হাসপাতালে আসা হতাহত এবং ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ করছিল। হাসপাতালের ভেতরে প্রবেশ করে চিকিৎসায় বাধা সৃষ্টি করছিল। আমরা জীবনবাজি রেখে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি।’

৩ আগস্ট থেকে হাসপাতালের স্থায়ী-অস্থায়ী মর্গ লাশের স্তূপে ভরে ওঠে। একপর্যায়ে মর্গের বাইরে ছিন্নভিন্ন লাশগুলো ফেলে রাখতে দেখা যায়। অনেক লাশ অজ্ঞাত থাকায় মর্গ ও বারান্দায় পচে-গলে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল। অন্যদিকে লাশ পেতে অনেক স্বজন হাসপাতালে ভিড় জমাচ্ছিলেন। ১১ থেকে ১৩ আগস্ট ৮ জনের লাশ আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম