বিশ্লেষকদের অভিমত
রাজনীতির ভাগ্য নির্ধারণের বছর হবে ২০২৫
নতুন বছরে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে মানুষ * ভোটের মাঠে অবাধ রাজনীতি চর্চার সুযোগ তৈরি হবে
ছবি: সংগৃহীত
গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরেরও বেশি সময়ের একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ইতি ঘটেছে গেল ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন গণ-আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে কোনো মতে প্রাণ বাঁচান। এরপর ওই বছরেরই ৮ আগস্ট ফ্রান্স থেকে দেশে ফিরে শান্তিতে নোবেল জয়ী খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস হাল ধরেন প্রায় ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশের। হন অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। নানা মত এবং পথ পরিক্রমার মধ্য দিয়ে তিনি দেশটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ঋণের ভারে জর্জরিত বাংলাদেশকে মাথা উঁচু করে দাঁড় করাতে দৃপ্তপায়ে এগিয়ে চলছেন তিনি।
নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের যাত্রায় পুরোনো এবং ঘটনাবহুল ২০২৪ সালকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছর ২০২৫ সালে পা রাখলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে পথ চলার নতুন এই অভিযাত্রায় সবাইকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, তিনি রাজনীতির মানুষ নন। ছাত্র-জনতার চাওয়ার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হাল ধরেছেন ক্ষতবিক্ষত বাংলাদেশের। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের মহানায়ক ছাত্র-জনতার চাওয়াকে প্রাধান্য দিতে এবং সহস্রাধিক শহিদের আত্মত্যাগের বিষয়টি মাথায় রেখে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা অর্পণ করে ফিরে যাবেন তার প্রিয় পেশায়, যা তিনি জীবনভর উপভোগ করে আসছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, রাজনীতির ভাগ্য নির্ধারণের বছর হতে পারে ২০২৫ সাল। এ বছরই গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছেন দেশের মানুষ। দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগের হতাশা কাটিয়ে ওঠা মানুষগুলোর প্রত্যাশার ভার বইতে হবে নতুন বছরকে। এ বছরই তারা ভোটের মাঠে অবাধ রাজনীতির চর্চার সুযোগ পাবেন এমনটাই আশা করছেন। অর্থনৈতিক সংকট কেটে যাবে, বন্ধ হবে টাকা পাচার, ঋণ খেলাপির সংস্কৃতির অবসান হবে। ফেরত আনা হবে পাচারের টাকা। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। বন্ধ হবে গুম খুন। সমুন্নত হবে মানবাধিকার। সরকারের কাছে চাওয়ার আছে অনেক কিছু। এরই মধ্যে অনেকেই দাবি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এর কিছু আদায় হয়েছে, প্রক্রিয়াধীন আছে কিছু। সব মিলে দেশবাসীকে কিছু দেওয়ার সদিচ্ছা সরকারের তা প্রমাণ হয়ে গেছে। এই প্রাপ্তির রেশ ধরেই বাড়ছে প্রত্যাশা।
কোটা সংস্কার ঘিরে গড়ে ওঠা যে আন্দোলন, যার নেতৃত্ব দিয়েছে এদেশের তরুণ ছাত্র-যুবা ও জনতা। পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের নিষ্ঠুর দমন-পীড়নেও যা দমানো যায়নি, প্রতিহত করা যায়নি। বরং কোটা সংস্কারের ওই আন্দোলন এক সময় সরকার পতনের ‘একদফা’য় রূপ নেয়। দেশের রাজনীতির ইতিহাসের বাঁক বদলের এক মহা অধ্যায় রচিত হয় জুলাই-আগস্ট। সূচিত হয় নতুন বাংলাদেশের যাত্রা। ‘তারুণ্যের হাত ধরে ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ’-এমন প্রত্যয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দল, রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক কর্মী, কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষ, আইনজীবী, চিকিৎসক, শিক্ষক, সাংবাদিক, অর্থনীতিবিদ, সংস্কৃতি কর্মী, বৃদ্ধিজীবীসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ ছাত্রদের দাবির সঙ্গে একাত্ম হয়। সবার সম্মিলিত স্রোতধারায় রচিত ইতিহাসের নয়া অর্জনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ২০২৫ সাল। অমিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে বছরটি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, লাল-সবুজের বাংলাদেশে ২০২৫ এসেছে সম্পূর্ণ নতুন এক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অফুরান সম্ভাবনা নিয়ে। এই পরিবর্তনের পূর্বাভাস কয়েক দিন আগেও ঘুণাক্ষরে টের পাওয়া যায়নি। ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে সাংবিধানিক সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই শেখ হাসিনার একচ্ছত্র কর্তৃত্ববাদী শাসন চলেছে দোর্দণ্ড প্রতাপে। পরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচনকে জঘন্য কারচুপি এবং জবরদস্তির মাধ্যমে প্রহসনে পরিণত করে তিনি একটানা দাপটের সঙ্গে ক্ষমতায় ছিলেন। সেসময় কখনো দিনের ভোট রাতে, কখনো ভোট ছাড়াই নির্বাচনের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে দেশে। জবাবদিহিতার বালাই ছিল না, যার সুযোগ নিয়ে ওই সময়ে নজিরবিহীন দুর্নীতি এবং লুটপাট হয়। ব্যাংক দখল, অর্থপাচার এবং খেলাপি ঋণ ছিল এ দেশের অর্থনীতির মূল অনুষঙ্গ। নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের নামে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে মেগা দুর্নীতি আর লুটপাটের মহারণে লিপ্ত ছিলেন তৎকালীন ক্ষমতানসীন দলটির নেতা-কর্মীরা। গণতান্ত্রিক কাঠামো ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়ায় দলীয় সুবিধাভোগী গোষ্ঠীগুলোর হাতে জিম্মি ছিল জনজীবন।
এই সময় বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী শিবিরের রাজনৈতিক দলগুলো শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রাম করলেও অনেক বছর সফল হয়নি। সাধারণ মানুষ যখন ধরেই নিয়েছিল, ‘বিনা ভোটের সরকারই তাদের একমাত্র নিয়তি’ ঠিক তখন সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটার বিরুদ্ধে ছাত্র-যুবকরা আন্দোলন গড়ে তোলেন। যা ন্যায়সঙ্গতভাবে মোকাবিলা করতে না পারা এবং অতিরিক্ত বলপ্রয়োগে অনেক ছাত্র-তরুণের মৃত্যু ঘটায় মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে তেড়েফুঁড়ে এসে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনাকে তখতে তাউস থেকে ছুড়ে ফেলে দেয়। তিনি পালিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নেন। ত্বরিৎগতিতে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটলেও এ আন্দোলন যে হঠাৎ নয়, আগেভাগেই এজন্য নিপুণ পরিকল্পনা করা হয়েছিল সে কথা স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে বিল ক্লিনটনের গবেষণা প্রতিষ্ঠানে প্রকাশ্য সভায় বলেছেন। তিনি বলেন, ছাত্র আন্দোলনে কারা নেতৃত্ব দিচ্ছে তা জনগণ জানত না। এভাবেই ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনকে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছিল।
দায়িত্ব নিয়েই সংস্কারের জন্য ১১টি কমিশন গঠন করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রাজনৈতিক দলগুলো এতে সমর্থন দিয়ে বলে, সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে রাজি। একই সঙ্গে তারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য একটি রোডম্যাপ প্রণয়নেরও দাবি জানায়। ইতোমধ্যে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। বিচার বিভাগকে ঢেলে সাজানোর কাজ চলছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নতুন চেয়ারম্যানসহ বাকি সদস্যরা পুরোদমে কাজ শুরু করেছেন। সংবিধান, বিচার বিভাগ, নির্বাচনি ব্যবস্থা, স্থানীয় সরকার, জনপ্রশাসন, গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন বিষয়ে গঠিত সংস্কার কমিশন কাজ শুরু করেছে। অনেকেই তাদের কাজ শেষ করে এনেছেন বলেও জানা গেছে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ছয়টি সংস্কার কমিশন তাদের প্রস্তাব জমা দেবে। এর পরই সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রস্তাবগুলো নিয়ে এবং নির্বাচনের বিষয়ে আলোচনা শুরু করবে।
বিশ্লেষকদের মতে, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে ২০২৫ সালেই নির্বাচনের দাবিতে রাজনৈতিক দলগুলো আরও একাট্টা । নতুন ভোটার তালিকা প্রণয়ন, নির্বাচনি ব্যস্থার সংস্কার শেষে যাত্রা শুরু করবে নির্বাচনি ট্রেন-এমনটাই প্রত্যাশা সবার। বিশেষ করে আগামী মার্চে রমজান মাস শেষে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের দাবিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে রাজপথে শামিল হবে। পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন উর্ধ্বগতি রোধ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নসহ আরও বেশ কিছু দাবিতে মাঠে নামবে তারা। বসে থাকবে না জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলনে সফল ছাত্র নেতারাও। তারাও সংবিধানসহ নানা বিষয়ে সংস্কারের দাবিতে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখবে। সব মিলিয়ে রাজনীতির ভাগ্য নির্ধারণের বছর হবে ২০২৫ সাল। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্বটা ভোটের মাধ্যমে রাজনীতিবিদদের কাঁধেই বর্তায়। তাই ভোটের অধিকার এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার বছরও হতে পারে নতুন বছরটি।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনের সময় নিয়ে একটা ধারণা দিলেও তাতে সন্তুষ্ট হয়নি দলগুলো। কারণ নির্বাচন কবে হতে পারে, তা নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি সরকার। বিএনপি এবং অন্যান্য দল বলছে, নির্বাচন নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য না দেওয়ায় অনেকেই খুশি নয়। বিএনপি এবং তাদের মিত্র দল ও জোটগুলো এবং জামায়াতে ইসলামী প্রয়োজনীয় সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে রোডম্যাপ দাবি করে আসছে। তবে গত বছর ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনের সময় নিয়ে একটা ধারণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়।
পরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘আশা করতে পারেন যে নির্বাচন হচ্ছে ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে।’ তবে বিএনপি নেতৃত্ব মনে করে, নির্বাচনের জন্য লম্বা সময়ের প্রয়োজন নেই। তারা দ্রুত নির্বাচন চাইছে। এদিকে জামায়াতে ইসলামী সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় সময় দেওয়ার কথা বললেও এখন ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন দাবি করছে। দেরিতে হলেও সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্বাচনের কথা বলায় এটিকে রাজনৈতিক দলগুলো ইতিবাচক হিসাবে দেখছে। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে বক্তব্য স্পষ্ট নয় এবং সময় নিয়ে একটা ধারণা দেওয়ার ব্যাপারেও বিএনপিসহ তাদের সমমনা দলগুলোর সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি বলে অভিযোগ করেছে তারা। এখন দলগুলো তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে দ্রুত নির্বাচনীয় রোডম্যাপ তৈরির দাবি করছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এবারের নতুন বছরটি বাংলাদেশের জন্যও এক নতুন আশার আলোয় আলোকিত হবে। নতুন বছরে নতুনভাবে দেশের মানুষ পাবে নতুন গণতান্ত্রিক সরকার। সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থার যাত্রা শুরু হবে। নতুন সরকার আরও বেশি তারুণ্যনির্ভর হবে। তারা তরুণ সমাজের জন্য আরও বেশি কাজ করে সেই প্রত্যাশা থাকবে জনমনে। বর্তমান তরুণ প্রজন্ম কথায় নয়, কাজে বিশ্বাস করে। তাদের আশ্বাস নয়, বিশ্বাস দিতে হবে। মনে রাখতে হবে তরুণরাই দেশের ভবিষ্যৎ। তাদের সুযোগ না দেওয়া মানে দেশকে ধ্বংস করে দেওয়া। নতুন বাংলাদেশ গড়তে তরুণদের সফলতা এনে দিতে হবে, এটাই তারুণ্যের চাওয়া। তরুণদের পাশে থেকে তাদের সুযোগ দিয়ে দেশকে আরও সমৃদ্ধ এবং সুন্দর করে গড়ে তুলতে হবে। স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনের ছাত্র নেতৃত্বের কয়েকজন সরকারে রয়েছেন। তাদের পক্ষ থেকে নতুন দল গঠনের কথাও বলা হচ্ছে। নতুন বছরের রাজনীতিতে এই বিসয়টিও সবার নজরে থাকবে।