সংশোধন হচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংক আইন
চেয়ারম্যান নিয়োগের পদ্ধতি বদলাচ্ছে
পর্ষদে সরকারের নিযুক্ত পরিচালকের সংখ্যা কমছে, বাড়ছে ঋণগ্রহীতা শেয়ারহোল্ডারদের * এমডির চাকরির বয়স ৬০ থেকে বেড়ে ৬৫ হচ্ছে
গ্রামীণ ব্যাংক আইন সংশোধন হচ্ছে। এ লক্ষ্যে চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিধিবিধানে পরিবর্তন আসছে। এর মাধ্যমে ঋণগ্রহীতা শেয়ারহোল্ডারদের আরও শক্তিশালী ও ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনে সরকারি অংশের অনুপাত কমিয়ে বাড়ানো হচ্ছে ঋণগ্রহীতা শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ারের আনুপাতিক হার। ভবিষ্যতে পর্যায়ক্রমে পরিশোধিত মূলধনের অঙ্ক ঋণগ্রহীতা শেয়ারহোল্ডারদের পক্ষ থেকে বাড়ানোর সুযোগ থাকলেও সরকারের পক্ষে এ ধরনের কোনো বিধান থাকছে না। পরিচালনা পর্ষদ থেকে কমিয়ে আনা হচ্ছে সরকারের নিযুক্ত পরিচালকের সংখ্যাও।
ইতোমধ্যে গ্রামীণ ব্যাংকের সংশোধিত আইনের খসড়ার ওপর সংশ্লিষ্টদের মতামত নিয়ে কাজ শুরু করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি)। খসড়ায় বলা আছে, গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ড পরিচালকদের মধ্য থেকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন। বিদ্যমান আইনে ব্যাংকের বোর্ডে সরকারের নিযুক্ত পরিচালকদের মধ্য থেকে চেয়ারম্যান নিয়োগের বিধান আছে। সরকারই এ নিয়োগ দিয়ে আসছে। এছাড়া এমডি নিয়োগে উপযুক্ত প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করে দেবে ব্যাংকের বোর্ড। সেখানে সদস্য থাকবেন ৩ থেকে ৫ জন। তবে বিদ্যমান আইনে আছে প্রার্থী বাছাইরে ক্ষেত্রে চেয়ারম্যান পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে আলাপ করে একটি সিলেকশন কমিটি গঠন করবেন, যাতে তিন থেকে পাঁচ জন থাকবেন। অর্থাৎ বিদ্যমান আইনে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডি নিয়োগ, সিলেকশন কমিটি গঠনের ক্ষমতা ছিল বোর্ডে সরকার নিযুক্ত পরিচালকদের হাতে। সংশোধিত আইনে সেটি বোর্ডের পর্ষদের হাতে থাকছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, স্বচ্ছ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি) সূত্র মতে, সংশোধিত আইনটি ‘গ্রামীণ ব্যাংক (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪ নামে অভিহিত হবে। গত ১৯ ডিসেম্বরের মধ্যে সংশোধিত খসড়া আইনের ওপর সংশ্লিষ্টদের মত চাওয়া হয়েছিল। মত পাওয়ার পর এখন চূড়ান্ত প্রক্রিয়ার দিকে এগোচ্ছে আইনটি।
অবশ্য এর আগে ২০১২ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালক নিয়োগে বিধান পরিবর্তন করে আইনটি সংশোধন করেছিল। ওই সময় দেশের ব্যাংকিং ও অর্থনীতি খাতের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই সেটাকে অযৌক্তিক বলে মনে করছেন। কারণ এতে গ্রামীণ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কাজকর্ম চালাতে সমস্যা সৃষ্টি হবে। একযুগের বেশি সময়ের পর গ্রামীণ ব্যাংক আইনের আরেক দফা সংশোধন আনছে অন্তর্বর্তী সরকার।
চেয়ারম্যানের দায়িত্ব প্রসঙ্গে খসড়া আইনে বলা আছে, যদি পদটি শূন্য হয়, কিংবা অনুপস্থিত, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে এমডি ছাড়া অন্য কোন পরিচালক চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।
বিদ্যমান আইনে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ৬০ বছর পর্যন্ত চাকরি করার বিধান থাকলেও সংশোধিত খসড়া আইনে বলা হয়েছে, বোর্ডের বিবেচনায় ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালনার স্বার্থে এমডির চাকরির মেয়াদ বোর্ড কর্তৃক সর্বোচ্চ ৬৫ বছর পর্যন্ত বাড়াতে পারবে। এছাড়া এমডি পদ ৩ মাস শূন্য থাকলে বোর্ড নিজস্ব সিদ্ধান্তে নিয়োগ দিতে পারবে। তবে বিদ্যমান আইনে আছে উল্লেখিত পরিস্থিতিতে এমডির পদ শূন্য থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনক্রমে ব্যাংকের বোর্ড কর্তৃক মনোনীত উর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্ব পালন করবেন।
পদত্যাগ প্রসঙ্গে বলা হয়, চেয়ারম্যান বা এমডি বা অন্য কোনো পরিচালক বোর্ডের কাছে লিখিত পত্রযোগে পদত্যাগ করতে পারবেন। তবে শর্ত থাকে, বোর্ড কর্তৃক গ্রহণ না হওয়া পর্যন্ত কোনো পদত্যাগ কার্যকর হবে না।
এছাড়া বর্তমান পর্ষদ বোর্ডে সরকারের নিযুক্ত ৩ জন এবং ঋণগ্রহীতা শেয়ারহোল্ডার থেকে নির্বাচিত ৯ পরিচালক আছেন। কিন্তু সংশোধিত আইনে সরকারের পরিচালক তিনজন থেকে কমিয়ে একজন এবং ঋণগ্রহীতা শেয়ারহোল্ডার ৯ জন থেকে নির্বাচিত পরিচালকের সংখ্যা বাড়িয়ে ১১ জন করা হচ্ছে।
এছাড়া কার্যাবলি প্রসঙ্গে সংশোধিত খসড়ায় বলা হয়েছে, নির্বাচিত পরিচালকগণ কার্যকাল থেকে প্রতি মেয়াদে তিন বছর এবং সরকারের নিযুক্ত প্রত্যেক পরিচালক সরকারের সন্তুষ্টি অনুযায়ী প্রতি মেয়াদে তিন বছরের বেশি থাকতে পারবেন না। তবে কোনো পরিচালক ধারাবাহিকভাবে দুমেয়াদের বেশি পরিচালক থাকতে পারবেন না। এক্ষেত্রে দুমেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী তিন বছর না হওয়া পর্যন্ত ব্যাংকের পরিচালক পদে পুনঃনির্বাচন করতে পারবেন না।
খসড়ায় গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠার বিষয়ে একটি সংর্ক্ষিপ্ত তথ্যবহুল ব্যাখা প্রতিস্থাপন করা হয়। সেখানে বলা হয়, “গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ ১৯৮৩-এর মাধ্যমে স্থাপিত গ্রামীণ ব্যাংক, যা ‘গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প’ থেকে উদ্ভূত, এমনভাবে বহাল থাকবে যেন তা এ আইনের অধীনে স্থাপিত হয়েছে।” ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানার জোবরা গ্রামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের গ্রামীণ অর্থনীতি কর্মসূচির আওতায় গৃহীত গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প; যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনুমোদিত হয় এবং এতে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংক অংশগ্রহণ করে।
খসড়ায় গ্রামীণ ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন হবে ৩০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের বা সরকার পরিচালিত বা নিয়ন্ত্রিত একক বা যৌথভাবে মোট শেয়ারের পরিমাণ ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। আর ৭৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯৫ শতাংশ শেয়ায়ের মালিক করা হয়েছে ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের (শেয়ারহোল্ডার)।
ব্যাংকের ঋণগ্রহীতারা ক্রমান্বয়ে পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর পাশাপাশি পরিচালনা বোর্ড কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করলে পরিশোধিত শেয়ার মূলধনের অনুপাতে দেওয়া হবে।
গ্রামীণ ব্যাংকের খসড়া আইনে ‘ভূমিহীন ব্যক্তি’র সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে। কারণ এ ব্যাংকের ঋণ নিয়ে থাকেন সাধারণ গরিব ও ভূমিহীন মানুষ। সেখানে বলা হয়, ভূমিহীন ব্যক্তি হবেন সেরূপ ব্যক্তি-যিনি বা যার পরিবার ৫০ শতাংশের কম চাষযোগ্য জমির মালিক, কিংবা স্থাবর ও অস্থাবর উভয় ধরনের সম্পত্তির মালিক যার মূল্য তিনি যে ইউনিয়নে বাস করেন সেখানের বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী ১ একর চাষযোগ্য জমি, পৌরসভার ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ জমি ও সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে ২ শতাংশ জমির দামের অধিক নয়।