হাজার কোটি টাকা গচ্চা যাওয়ার শঙ্কা
প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশৃঙ্খলা এডিপিতে বড় ধাক্কা
ফিরে দেখা ২০২৪
উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে চলছে বিশৃঙ্খলা। এ কারণে বড় ধাক্কা লেগেছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি)। যার শুরু হয়েছিল গত অর্থবছরের মাঝামাঝিতে। জাতীয় নির্বাচনের চাপে সেসময় প্রকল্প বাস্তবায়ন ছিল কম। সেই ধকল সামলে উঠতে না উঠতেই চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই ছাত্র-জনতার আন্দোলন এবং সরকার বদলের ঘটনায় সংকট গভীর হয়। অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং সময়মতো সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় উন্নয়ন কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় এডিপি কাটছাঁটের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ফলে এবার বড় অঙ্কের বরাদ্দ ছেঁটে ফেলতে হবে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, পত্রপত্রিকার খবরে দেখছি সরকার কিছু প্রকল্প বাছাই করছে। এটি ভালো উদ্যোগ। এর মাধ্যমে অহেতুক নেওয়া প্রকল্প বাদ দিলে একদিকে যেমন অপচয় কমবে, অপরদিকে তেমনই অর্থনীতিতে চাপ কমবে। পাশাপাশি মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো শিক্ষা নেবে-যেনতেন প্রকল্প গ্রহণের দিন শেষ। আগের খেলা আর চলবে না। এসব কার্যক্রম করতে গিয়ে যদি এডিপির বাস্তবায়ন কিছুটা কমও হয়, তবে খারাপ নয়। কেননা এতে অপচয় কমানোর পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ কমানো সম্ভব হবে। কর্মসংস্থান এবং অর্থপ্রবাহ কমবে-এমন শঙ্কায় যেসব প্রকল্প অর্থনীতিতে কোনো প্রভাব রাখে না, সেগুলো চলমান রাখার কোনো মানে নেই।
সূত্র জানায়, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়। এজন্য ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সংশোধিত এডিপির বাস্তবায়ন ছিল অত্যন্ত কম। পুরো অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো ব্যয় করেছে ২ লাখ ৫ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা, যা মোট সংশোধিত এডিপি বরাদ্দের ৮০ দশমিক ৯২ শতাংশ। ওই অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৫৪ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির বাস্তবায়ন হার ছিল ৮৫ দশমিক ১৭ শতাংশ।
সেই ধারাবাহিকতা চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও অব্যাহত আছে। জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এডিপির বাস্তবায়ন হার দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ২৯ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ হার ছিল ১৭ দশমিক ০৬ শতাংশ। গত ৫ মাসে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো ব্যয় করতে পেরেছে ৩৪ হাজার ২১৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ১৯ হাজার ৪১১ কোটি, বৈদেশিক সহায়তার ১১ হাজার ৪০৭ কোটি এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন থেকে ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে খরচ হয়েছিল ৪৬ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ২৭ হাজার ২৯১ কোটি, বৈদেশিক ঋণ থেকে ১৮ হাজার ২৩ কোটি এবং সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন থেকে খরচ হয়েছিল ১ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা।
আইএমইডির অগ্রগতি প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো ১২টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের এডিপি বাস্তবায়নের হার রয়েছে ৫ শতাংশের নিচেই। এগুলোর মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৭টি প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দ আছে ১৪৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা। কিন্তু এখন পর্যন্ত এক টাকাও ব্যয় হয়নি। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এডিপি বাস্তবায়ন ১ দশমিক ২৪, জননিরাপত্তা বিভাগের ২ দশমিক ৯১, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ২ দশমিক ২১ এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে শূন্য দশমিক ২৪ শতাংশ। আরও আছে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের ২ দশমিক ৯২, স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের শূন্য দশমিক ০৫, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ৩ দশমিক ০৪, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ৪ দশমিক ১৫ এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের এডিপি বাস্তবায়ন ৪ দশমিক ০৪ শতাংশ। পাঁচ শতাংশের নিচে বাস্তবায়ন হার রয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে আর্থিক সংকট, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, অন্তবর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণসহ নানা কারণে চলমান ১ হাজার ৩৫২ প্রকল্পে বিরাজ করছে স্থবিরতা। ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সার্বিকভাবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন এবং বৈদেশিক অর্থছাড়ের ক্ষেত্রে। এ কারণে কর্মসংস্থান, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি, অর্থ প্রবাহের স্বাভাবিক গতি কমা এবং প্রকল্পগুলো থেকে প্রত্যাশিত সুফলপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি প্রকল্পগুলোয় মেয়াদ ও ব্যয়বৃদ্ধির শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, বলতে গেলে এডিপিভুক্ত সব প্রকল্পেই স্থবিরতা আছে। এর মূল কারণ হলো-চাহিদামতো অর্থছাড় না হওয়া। এখন কোন প্রকল্প প্রয়োজনীয় বা কোনটি রাজনৈতিকভাবে নেওয়া হয়েছিল, সেগুলোর যাচাই-বাছাই না করে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।
সাবেক পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশিদ যুগান্তরকে বলেন, দেশের সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থানের অন্যতম স্থান হলো প্রকল্প। সেই প্রকল্পই যদি বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে কর্মসংস্থান কমবে। এছাড়া দেশের উৎপাদনও কমবে। যেমন: বাংলাদেশ স্টিল মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন ইতোমধ্যে বলেছে তাদের বিক্রি ৫০ শতাংশ কমেছে। একই অবস্থা সিমেন্ট, ইটসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে। এটি মূলত প্রকল্প বাস্তবায়ন কম হওয়ার কারণেই হচ্ছে। এডিপির বাস্তবায়ন কম হওয়ায় ত্রিমুখী প্রভাব পড়বে। প্রথমত কর্মসংস্থান কমবে। দ্বিতীয়ত, প্রকল্পগুলোর ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। তৃতীয়ত, প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন সময়মতো না হওয়ায় পরবর্তী সময়ে অবকাঠামোগত সমস্যার সৃষ্টি হবে। সব মিলিয়ে মোটা দাগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে। সরকারের উচিত দ্রুত একটি স্টাডি করে দেখা আগামী এক বছরে প্রকল্প বাস্তবায়ন কম হলে এর কী প্রভাব পড়বে। সে অনুযায়ী নীতিনির্ধারণ করতে হবে।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে অনুমোদন পাওয়া নতুন প্রকল্পগুলোয়ও বরাদ্দ মিলছে না। পাশাপাশি চলমান অন্যান্য প্রকল্পেও আছে ধীরগতি। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এডিপিতে সাধারণ সরকারি সেবা খাতে মোট ৩৫টি প্রকল্পটি রয়েছে। এছাড়া প্রতিরক্ষায় ১২, জনশৃঙ্খলা ও সুরক্ষায় ২৭, শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবায় ৬৮, কৃষিতে ১৩৫, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে ৯৪, পরিবহণ ও যোগাযোগে ২২৮ এবং স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ১০২টি প্রকল্প আছে। আরও আছে পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ খাতে ১৩৯, গৃহায়ন ও কমিউনিটি সুবিধাবলিতে ২৬৬, স্বাস্থ্যে ৬৩, ধর্ম-সংস্কৃতি ও বিনোদনে ৫৭, শিক্ষায় ১১৯, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিতে ৫৪ এবং সামাজিক সুরক্ষা খাতে ৫৫টি প্রকল্প। পাশাপাশি সমীক্ষা, কারিগরি সহায়তা এবং স্ব-অর্থায়নের প্রকল্পও রয়েছে। এডিপিতে এসব প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া আছে ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) বলছে, প্রকল্পের বাস্তবায়ন কম হওয়ায় চলতি অর্থবছরের অর্থছাড় কমে গেছে। গত চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) উন্নয়ন সহযোগীরা ছাড় করেছে ১২০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ঋণ ১০১ কোটি ১৩ লাখ এবং অনুদান ১৯ কোটি ৬ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ে ছাড় হয়েছিল ১৬২ কোটি ৬১ লাখ ডলার। এর মধ্যে ঋণ ১৫৬ কোটি এবং অনুদান ৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। এছাড়া নতুন ঋণের প্রতিশ্রুতিতেও বিরাজ করছে দুরবস্থা। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে নতুন ঋণ অনুদানের প্রতিশ্রুতি এসেছে ২৫ কোটি ৪৫ লাখ ডলার। কিন্তু গত অর্থবছরের একই সময়ে প্রতিশ্রুতি ছিল ৩৬২ কোটি ৮৫ লাখ ডলার।