দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর অবজ্ঞা অবহেলা চরমে
ধুলাদূষণে বাজে দশা ঢাকার
বায়ুদূষণের সঙ্গে ধুলাদূষণে বাজে অবস্থা ঢাকার মানুষের। শীতের নগরে কুয়াশার চাদর ভেদ করে রোদের দেখা মিললেই দূষিত বাতাসের মাত্রটা টের পওয়া যায়। ঢাকার বাতাসে ভারী ধূলিকণার পরিমাণ বাড়তে বাড়তে ফের শীর্ষে পৌঁছেছে দূষিত বায়ুর তালিকায়। সুইস বায়ুমান পর্যবেক্ষণ সংস্থা আইকিউএয়ারের শহরভিত্তিক এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স-এ (একিউআই) দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকা কখনো প্রথম কখনো দ্বিতীয় বা তৃতীয় অবস্থানে থাকে। এর থেকে নিচে নামছেই না। শুক্রবার এবং শনিবার পরপর দুদিন দূষিত বায়ুর তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে আসে। যা খুব অস্বাস্থ্যকর হিসাবে বিবেচনা করা হয়। নগরের সড়কসহ যেটুকু খোলা জায়গা আছে তাও ধুলাবালির দখলে। বাতাসের সঙ্গে দূষিত ধুলা মিশে চরম অস্বস্তিকর অবস্থা সৃষ্টি করে। স্বস্তিতে শ্বাস নেওয়া নগরবাসীর জন্য যেন ভাগ্যের ব্যাপার।
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তাহমিদুর। তিনি কখনো পাবলিক পরিবহন, কখনো সিএনজি চালিত অটোরিকশা আবার কখনো দ্রুতযান পাঠাওয়ে অফিসে যাতায়াত করেন। করোনার সময় মানুষকে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরতে হতো। কিন্তু তাহমিদুর করোনা থেকে এখন পর্যন্ত বাইরে বের হলেই মাস্ক ব্যবহার করেন। তিনি তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, আমি মৌচাক থেকে নিয়মিত নর্দা, বারিধারায় অফিস করি। সবসময় চেষ্টা করি অফিস থেকে নতুন বাজার-বাড্ডা-রামপুরা সড়কটি পরিহার করতে। এ সড়কটি যাত্রীসাধারণের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। অনেক সময় যে যানবাহনে যাত্রা শুরু করি, জ্বালানি খরচ বেশি হবে মনে করে সেটি গুলশানের সড়ক না ধরে বাড্ডা-রামপুরা হয়েই যায়। সড়কটিতে যেতে খুব ভয় হয়। তাহমিদুর জানান, মুখে মাস্ক ও চোখে চশমা থাকা অবস্থায় মোটরসাইকেলে অফিস যাওয়ার পথে চোখে হঠাৎ করে এক ধরনের ধুলা ঢুকে যায়। চোখ খোলা যাচ্ছিল না। পানি পড়তে শুরু করে। অনেকক্ষণ পর চোখ খুলি। শুধু তাহমিদুরই নন, ঢাকার সব সড়কে যাতায়াতকারীদের একই অভিজ্ঞতা। নগরবাসীকে এই দশা থেকে রেহাই দিতে পারছে না তত্ত্বাবধায়করা। তাদের অবজ্ঞা অবহেলায় দিনে দিনে ঢাকা হয়ে পড়ছে বসবাস অনুপযোগী।
ইটভাটার কালো ধোঁয়া, নগরের উন্নয়নমূলক কাজে দীর্ঘ সময় ধরে খোঁড়াখুঁড়ি ও বর্জ্য পোড়ানোসহ নানা কারণে ঢাকার বাতাস দূষিত হলেও এখন ধুলাদূষণ প্রধান কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ভবন নির্মাণ ও নির্মাণসামগ্রীর কারণেও রাজধানীতে মারাত্মক ধুলাদূষণ হচ্ছে। এসব কারণের পাশাপাশি সড়কে যানবাহন ধুলাদূষণের জন্য বেশির ভাগ দায়ী। গাড়ি চললেই চারদিকে উড়ছে ধুলাবালু। আশপাশ দেখে চলাচল করা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। বিবর্ণ রাজধানীর গাছের পাতাও। বাইরে চলাচলকারী নগরবাসীর শরীরে ধুলাবালু এত পরিমাণ লাগছে যে; বেশিক্ষণ বাইরে থাকলে তাকে চেনাই দুষ্কর হয়ে পড়ে।
দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাসূত্রে জানা যায়, বছরের নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি- এই চার মাসে ঢাকার বাতাসের মান বেশি অবস্বাস্থ্যকর থাকে। বায়ুদূষণ বাড়ার সঙ্গে শিশুসহ সব বয়সি মানুষের অ্যাজমা, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন ধরনের শ্বাসতন্ত্রের রোগ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। রাজধানীর হাসপাতালগুলোয় এসংক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
যেসব সংস্থা ঢাকার আবহওয়া, ধুলা ও বায়ুদূষণ-সংক্রান্ত তদারকিতে নিয়োজিত সেই তালিকায় আছে-পরিবেশ অধিদপ্তর, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, রাজউক, মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ এবং পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস সেবাসহ বিভিন্ন সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থা। এর মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়া বাকি সংস্থাগুলো নগরবাসীর সেবা নিশ্চিত করতে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির মাধ্যমে উন্নয়নকাজ করে থাকে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, উন্নয়ন ও নির্মাণ কাজের সময় খুব সতর্কতার সঙ্গে ঢেকে কাজ করার বিধান রয়েছে। পাশাপাশি ধুলা নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত না হলেও এক বা দু’দিন অন্তর পানি ছিটানো এবং নির্মাণসামগ্রী ঢেকে গাড়িতে পরিবহণ করার কথা। বায়ু ও ধুলাদূষণ যেন না হয় তার জন্য ঠিকাদারদের বাড়তি বরাদ্দও রয়েছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই নগরবাসী সুফল পাচ্ছেন না। এসব দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, প্রতিকার নেই।
সরেজমিন দেখা গেছে, ডেমরা-রামপুরা সড়ক সংস্কারকাজ মন্থরগতিতে চলছে। পাশাপাশি নির্মাণসামগ্রী খোলা জায়গায় ফেলে রাখা হয়েছে। কুড়িল প্রগতি সরণি সড়কে মেট্রোরেল লাইন-১ এর সেবা সংযোগ স্থানান্তর কাজ চলছে। এতে প্রচুর ধুলার সৃষ্টি করছে। কয়েক মাস ধরে এই কাজ চলছে। কিন্তু ধুলা নিয়ন্ত্রণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে পানি ছিটাতে দেখা যাচ্ছে না। নগরীর ব্যস্ততম এই সড়কে প্রতিদিন লাখো মানুষ চলাচলে ধুলাদূষণে রীতিমতো নাকাল হচ্ছেন।
তেজগাঁও নাখালপাড়া রেললাইন সম্প্রসারণের কাজে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। ধুলা ধূসরিত পুরো এলাকা। আব্দুল্লাহপুর থেকে ঢাকা-আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্প এলাকায়ও একই অবস্থা বিরাজ করছে। সাভার থেকে শ্যামলী, মহাখালী, মিরপুর, উত্তরা ও পুরান ঢাকার সর্বত্র ধুলার রাজত্ব চলছে। একই অবস্থা বিরাজ করছে রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ থেকে বসিলা পর্যন্ত সড়কে। পরিষ্কার কাপড় পরে ওই সড়কে চলাচল করলে তা আবার পরিষ্কার না করে আর ব্যবহার করার কোনো সুযোগ নেই।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাংক ও পরিবেশ অধিদপ্তর ঢাকার বায়ুদূষণ বিষয়ে যৌথ গবেষণা করে। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসে, ঢাকার বায়ুদুষণের প্রধান তিনটি কারণ রয়েছে। তা হলো-নির্মাণ কাজের সৃষ্ট ধুলা, ইটভাটার ধোঁয়া ও যানবাহনের ধোঁয়া। এই প্রতিবেদনের তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার হুবহু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) তথ্যমতে, বছরে ঢাকায় গড়ে ৫০০টি নতুন ভবন তৈরি হয়। এসব ভবনের নির্মাতাদের অধিকাংশই ধুলার উৎস প্রতিরোধ না করেই ভবন নির্মাণ করেন। পাশাপাশি প্রতি বছরই শুষ্ক মৌসুমে ঢাকার সড়কে বিভিন্ন সেবা সংস্থার খোঁড়াখুঁড়ি চলে। সেসব থেকেও প্রচুর ধুলা তৈরি হয়। চলতি মৌসুমে সিটি করপোরেশন এলাকায় নর্দমা, ফুটপাত, সড়ক, পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগসহ বিভিন্ন সংস্থার উন্নয়ন কাজের জন্য প্রায় ৩০০ কিলোমিটারের বেশি সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। এসব সড়কের উন্নয়ন কাজের সঙ্গে জড়িত ঠিকাদারদের ধুলা নিয়ন্ত্রণ করে কাজ করার কথা থাকলেও তারা তা করছেন না। ঢাকার আশপাশে শত শত ইটভাটা রয়েছে। এসব ইটভাটার ধোঁয়া ঢাকার বাতাসকে দূষিত করছে। সরকার উন্নয়ন ও নির্মাণ কাজে ইটের পরিবর্তে কংক্রিটের ব্লক ব্যবহারের নির্দেশনা দিলেও তাতে কার্যত তেমন সফলতা মেলেনি।
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) তথ্যমতে, ঢাকার এক-তৃতীয়াংশ মোটরযান অর্থাৎ, প্রায় সাত লাখ গাড়ি দূষণের কারণ। এ ছাড়াও যানবাহনের নিম্নমানের জ্বালানিও ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। আর বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে, ঢাকার আশপাশের এলাকায় ২০ হাজার ট্রাক বালু, ইট, সিমেন্ট, নির্মাণ এলাকার মাটি, পাইলিংয়ের কাদামাটি, রেডিমিক্স কংক্রিট ব্যবহার করে। এসব ট্রাক গাবতলী, আমিন বাজার, মোহাম্মদপুর, বছিলা, আব্দুল্লাহপুর, শ্যামপুর, পোস্তগোলা, সারুলিয়া, কাঁচপুরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে বালু ও অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় চলাচল করে।
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, ঢাকার বাতাস বেশি অস্বাস্থ্যকর থাকে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত। অন্যান্য বছরের মতো এবারও একই অবস্থা; বায়ুদূষণের চিত্র একই রকমের।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ নজরুল ইসলাম জানান, রাজধানীর পরিবেশ দূষণের প্রধান কারণ ধুলা। এটা সৃষ্টি হচ্ছে-উন্নয়নকাজ, নির্মাণকাজ, নির্মাণসামগ্রীর অপরিবেশবান্ধব পরিবহণও ব্যবহারের ফলে। এছাড়া সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সড়ক ঝাড়ু দিয়েও নগরীকে ধুলোময় করে তোলা হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যাদের কাজ করার কথা; তারা কাজ করছে না। যার ফলস্বরূপ নগরবাসীকে এ বিষয়ে চরম খেসারত দিতে হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, শীতকালে বৃষ্টির পরিমাণ কম হয়। এজন্য ধুলার পরিমাণ বেড়ে যায়। এর ফলে মানুষের সর্দি, কাশি, অ্যাজমা ও শ্বাসজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। এছাড়াও ডায়রিয়া, চর্মরোগ, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন অনেক। এই সময়ে বাইরে কম বের হতে হবে। আর বের হলেও মাস্ক পরে বের হওয়া এবং শরীর ও মাথা ঢেকে বের হতে হবে। পাশাপাশি বাসাবাড়িতে গরম পানি খাওয়া এবং কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করার চেষ্টা করা করতে হবে। তাহলে এ ধরনের ধুলোদূষণজনিত অসুখ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব হবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. আবদুন নূর সায়েম যুগান্তরকে বলেন, ধুলাদূষণের ফলে হাঁচি, কাশি, হাঁপানি, অ্যালার্জি বেড়ে যায়। এছাড়া নিউমোনিয়া, যক্ষ্মাও বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। এ বিষয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, নির্মাণকাজ ও নির্মাণসামগ্রীর কারণে রাজধানীতে মারাত্মক ধুলাদূষণ হচ্ছে। এটা বন্ধে রাজউকেরও ভূমিকা পালন করা দরকার। তবে এ বছরে এ ধরনের কোনো তৎপরতা শুরু করেনি রাজউক।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজী মো. বোরহান উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, রাজধানীতে ধুলাদূষণ মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এটা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন ইতোমধ্যে একাধিক সভা করেছে। সার্বিক কার্যক্রম তদারকি করতে একটি কমিটিও গঠন করেছে। আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে কার্যক্রমগুলো তদারকি করা হবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশরী মো. শরীফ উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, শীতের মৌসুমে রাজধানীতে ধুলাদূষণ বেড়ে যায়। এ সময়ে সিটি করপোরেশন নিজস্ব গাড়িতে করে পানি ছিটিয়ে থাকে। পাশাপাশি উন্নয়ন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধুলো সৃষ্টি না করে কাজ করতে নির্দেশনা দিয়ে থাকে। ইতোমধ্যে সেসব কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।