Logo
Logo
×

শেষ পাতা

পাবলিক অডিট বিলের খসড়া

১৬ বছর পর মতামতের জন্য উন্মুক্ত

নিরীক্ষাকালীন মামলা নয় সিএজিসহ অডিট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে

Icon

মিজান চৌধুরী

প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

১৬ বছর পর মতামতের জন্য উন্মুক্ত

মন্ত্রণালয়ে আটকে থাকার দীর্ঘ ১৬ বছর পর অন্তর্বর্র্তীকালীন সরকার মতামতের জন্য উন্মুক্ত করছে ‘পাবলিক অডিট বিল-২০২৪’ এর খসড়া। যদিও ২০০৮ সালে এটি প্রণয়নের প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ এবং ২০১২ সালে বিলের খসড়া তৈরির পর তা পড়েছিল। অথচ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয় বাজেটের লাখ লাখ কোটি টাকা প্রতিবছর ব্যয় করলেও কোনো আইন ছাড়াই অডিট কার্যক্রম চলে আসছে। শুধু তাই নয়, অডিট আইন না করার পাশাপাশি ‘আয়কর আইন-২০২৩’-এ সরকারি প্রতিষ্ঠানের নথিপত্র যাচাইয়ের ক্ষেত্রে অডিটরদের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছিল। ফলে রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয়কে ঘিরে গড়ে উঠে ভয়াবহ দুর্নীতি, অপচয় ও অনিয়মের সংস্কৃতি।

১৯ ডিসেম্বরের মধ্যে মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর ও সংস্থার মতামত চেয়ে সম্প্রতি ‘পাবলিক অডিট বিল-২০২৪’ এর খসড়া অর্থ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। তবে বিলে উল্লেখযোগ্য একটি বিধানে বলা হয়, সংবিধান বা পাবলিক অডিট বিল আইন বা সংসদ কর্তৃক প্রণীত অন্য কোনো আইনে দায়িত্ব পালনকালে ‘মহাহিসাব নিরীক্ষক বা তার নির্দেশনায় কর্মরত কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা করা যাবে না।’

জানতে চাইলে সাবেক বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী যুগান্তরকে জানান, আইন না থাকায় অডিট করতে গেলে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো সংশ্লিষ্ট অডিট কর্মকর্তাদের। এ আইনটি হলে নিরীক্ষক ও যে প্রতিষ্ঠানের অডিট হবে এর মধ্যে কোনো ধরনের প্রশ্ন বা ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হবে না। এর মধ্য দিয়ে জনগণের অর্থ ব্যয়ের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। যদিও এ আইনের খসড়া দীর্ঘদিন আগেই প্রণয়ন হয়েছিল।

এর আগে ২০২৩ সালের ১৬ এপ্রিল ৩ সপ্তাহের সময় দিয়ে এ বিলের খসড়ার ওপর উন্মুক্ত মতামত চেয়েছিল অর্থ বিভাগের প্রশাসন ও সমন্বয় অনুবিভাগ। কিছু মতামতও পান তারা। পরে প্রাপ্ত মতামত বিশ্লেষণের জন্য অতিরিক্ত সচিব মো. গোলাম মোস্তফাকে প্রধান করে একটি কমিটিও করে দিয়েছিল অর্থ বিভাগ। সেই কমিটি সময়মতো প্রতিবেদন দাখিল করলেও রহস্যজনক কারণে পরে আর বেশি দূর এগোয়নি।

প্রস্তাবিত পাবলিক অডিট বিলের খসড়া বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বড় একটি নতুন ক্ষেত্র অডিট কার্যক্রমের আওতায় আনা হয়েছে। সেটি হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) আইনে বাস্তবায়নধীন প্রকল্পের অর্থ ব্যয়কে। অর্থাৎ পিপিপির আওতায় আগে প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও সেটির ব্যয়ের ওপর কোনো ধরনের অডিট হতো না। সেটি আগামীতে অডিট হবে যা নতুন বিলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রস্তাবিত পাবলিক অডিট বিলের খসড়ায় বলা হয়, পিপিপি চুক্তি, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব ব্যবস্থা, বেসরকারি অংশীদার নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের মাধ্যমে নেওয়া প্রকল্পের লক্ষ্য অর্জন বিষয়ে অডিট করতে পারবেন মহাহিসাব নিরীক্ষক।

জানা গেছে, বর্তমান ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা বাইপাস রোড, রামপুরা-আমুলিয়া-ডেমরা এক্সপ্রেসওয়ে, পূর্বাচল পানি সরবরাহ প্রকল্প, মোংলা বন্দরে দুটি জোন স্থাপন, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল, ঝিলমিল হাউজিং প্রকল্পসহ বেশকিছু প্রকল্প পিপিপির মাধ্যমে বাস্তবায়নে চুক্তি হয়েছে। এসব প্রকল্পসহ পিপিপির আওতায় ৭৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এতে মোট বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা রয়েছে ৪২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এসব ব্যয়কে ঘিরে অডিট কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে যা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে নতুন বিলে।

সাবেক সিএজি মুসলিম চৌধুরী মনে করেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, হানিফ ফ্লাইওভারসহ এ ধরনের পিপিপির আওতায় বাস্তবায়ন হয়েছে সেগুলোর ব্যয় আগে অডিট করার নিয়ম ছিল না। অথচ এখানে জনগণের অর্থ রয়েছে। ফলে সার্বিক বিবেচনায় নতুন পাবলিক অডিট বিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি ব্যয়ের স্বচ্ছতা দরকার।

পাবলিক অডিট বিলে যা আছে : আইন, বিধিবিধান পালনের আগে যে উদ্দেশ্যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয় তা মিতব্যয়িতা ও দক্ষতার সঙ্গে উদ্দেশ্য পূরণে ব্যয় হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করতে সংযুক্ত তহবিলের ব্যয়ের সব অর্থ অডিট করা যাবে। সরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন, লাভ-ক্ষতির হিসাব, ব্যলেন্স শিটসহ সব হিসাব অডিটের আওতায় আসবে। এছাড়া সরকারি হিসাব থেকে পরিশোধের সব অর্থ অডিটের আওতায় আসবে।

রাজস্বসংক্রান্ত অডিটের আওতায় বলা হয়েছে-রাজস্ব সংযুক্ত তহবিল থেকে প্রাপ্য, সঠিকভাবে নির্ধারণ, জমা ও হিসাবভুক্ত হয়েছে কিনা এবং কর, করব্যতীত রাজস্ব সঠিকভাবে নিরূপণ ও আদায়ের ক্ষেত্রে পদ্ধতি ও ব্যবস্থা আছে কিনা সেটি অডিট হবে। এছাড়া সরকারের বিভিন্ন নগদ স্থিতি অডিটের আওতায় আসবে।

বিলের খসড়ায় আরও বলা হয়, কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও, ফাউন্ডেশন, ট্রাস্ট, চ্যারিটি, সুশীল সমাজের সংগঠনকে সংযুক্ত তহবিল থেকে ঋণ বা সাহায্য মঞ্জুরি, অর্থ, তহবিল, অনুদান, ভর্তুকি দেওয়া হলে সে অর্থ ব্যয় সম্পর্কে অডিট করা যাবে। তবে বিদেশি রাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক সংস্থায় সংযুক্ত তহবিল থেকে দেওয়া কোনো অনুদান বা ঋণের ক্ষেত্রে অডিট হবে না।

এছাড়া সব সরকারি দপ্তর, সরকারি কর্তৃপক্ষ, করপোরেশন, সরকারি কোম্পানি, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বা অনুরূপ সব সংস্থার মিতব্যয়িতা, দক্ষতা ও ফলপ্রসূতা নিয়ে অডিট করা যাবে।

সেখানে আরও বলা হয়, অডিটের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক ও বিদেশি সংস্থা, প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ, চুক্তি এবং সমন্বয় করতে পারবে।

বিলটি প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বলা হয়, প্রতিবছর সরকার জাতীয় বাজেট ঘোষণার পর ব্যয়ে মিতব্যয়িতা, অনিয়ম, আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। সে কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশের অডিট সংস্কৃতির সঙ্গে মিল রেখে এই পাবলিক অডিট বিল প্রণয়ন করা হয়েছে।

এদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ২০১৫ সালে ‘মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে ২০ দফা সুপারিশ করেছিল। সেখানে স্বল্পমেয়াদি সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল অনিয়ম, দুর্নীতি রোধকল্পে প্রস্তাবিত নিরীক্ষা আইন প্রণয়ন, জনবলকাঠামো ও নিয়োগের বিধিমালার অনুমোদন দেওয়া; সিএজিকে বাজেট, নিয়োগসহ সব বিষয়ে সাংবিধানিক স্বাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার নিশ্চিত করা; সিএজিসহ সব ধরনের নিয়োগকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা; সিএজিকে উচ্চ আদালতের বিচারপতির সমমর্যাদা দেওয়াসহ সব পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মর্যাদা বৃদ্ধি করা; নিরীক্ষা প্রতিবেদন সম্পন্ন করার ও জমা দেওয়ার সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা; সিএজি কার্যালয়ের অভিযোগ সেল সম্পর্কে সরকারি কার্যালয়গুলোকে জানানোর জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালানো এবং অভিযোগের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম