১০ বছরে বনে যান বিত্তবৈভবের মালিক
নদভী ছিলেন অবৈধ ব্যবসার নিয়ন্ত্রক
শহীদুল্লাহ শাহরিয়ার, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) সংসদীয় আসনের দুইবারের সাবেক এমপি ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দীন নদভী। এক দিনের জন্যও আওয়ামী লীগ করেননি আবু রেজা নদভী। এর পরও ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ থেকে রহস্যজনকভাবে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছিলেন। দিনের ভোট রাতে নিয়ে কিংবা বিনা ভোটের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসন থেকে। ভোটে নির্বাচিত না হলেও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রাপ্তিই বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল এলাকাবাসীর কাছে। এটিকে আওয়ামী লীগের ‘রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা’ হিসাবে অনেকে বিবেচনা করেন। তবে যেভাবেই হোক-দুই দফায় এমপি হয়ে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া এলাকা ১০ বছর শাসন করেছেন দাপটের সঙ্গে। নিজের স্ত্রী, শ্যালক, ভাতিজা ও পিএসকে দিয়ে সব ধরনের অপকর্ম করেছেন এলাকায়। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, ইটভাটা স্থাপন, পাহাড় কাটা, আবাদি জমির টপ সয়েল কাটা, অবৈধ সিএনজি ফিলিং স্টেশন স্থাপনাসহ সব ধরনের অবৈধ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে। তার ইশারা ছাড়া কিছুই হতো না। তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের কুমিরায় স্থাপিত আন্তর্জাতিক ইসলামিক ইউনিভার্সিটি (আইআইইউসি) দখল, এই প্রতিষ্ঠান দখল করে নিজের ও স্ত্রীর নামে বেনামে লাখ লাখ টাকা তছরুপ ও আত্মসাৎ করা, বিদেশি অনুদান এনে মসজিদ নির্মাণের নামে ব্যবসা করাসহ গুরুতর সব অভিযোগ ওঠে। এসব করে নদভী বিপুল অর্থ-বৈভবের মালিক বনে যান। ক্ষমতায় থাকার কারণে কেউ তার এসব অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস করেননি। তবে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েও দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরে যান নদভী। এর পর থেকেই এলাকায় তার দুঃশাসনের চিত্র একে একে বের হয়ে আসতে থাকে।
রোববার রাতে ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দীন নদভী রাজধানীর উত্তরা থেকে গ্রেফতার হয়েছেন। দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি, সন্ত্রাস-নৈরাজ্যসহ নানা অভিযোগে দলের ভেতর থেকেই প্রতিরোধের মুখে পড়েছিলেন তিনি। ২০২৪ সালে নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়ে এলাকা ছেড়েছিলেন। সবশেষ ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর একেবারে আত্মগোপনে চলে যান। দুই মেয়াদে নিজ এলাকায় সর্বগ্রাসী দাপট খাটানো নদভী শেষ পর্যন্ত পুলিশের জালে ধরা পড়েছেন। তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া থানায় ছাত্র-আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার অভিযোগে একাধিক মামলা দায়ের হয়েছে। এসব মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। সোমবার তাকে একদিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সাঙ্গু ও ডলু নদী থেকে যত্রতত্র অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে ১০ বছর ধরে তার নিয়ন্ত্রণে হয়েছে বালুর ব্যবসা। এই সময়ে ছোট-বড় ২২টি পাহাড় কেটে সাবাড় করা হয়েছে। বন উজাড় করে সেখানকার কাঠ জ্বালানো হয় ইটভাটায়। নদভীর অনুসারীরাই এসব নৈরাজ্যে নেতৃত্ব দেন। এসব অপকর্মের নেপথ্যে ছিলেন- নদভীর ভাতিজা মাদার্শা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আ ন ম সেলিম, শ্যালক সাতকানিয়ার চরতি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রুহুল্লাহ চৌধুরী এবং পিএস ও লোহাগাড়া থেকে নির্বাচিত জেলা পরিষদ সদস্য এরফানুল হক চৌধুরী। অভিযোগ রয়েছে, নদভী নিজে যেমন বিনা ভোটে ও দিনের ভোট রাতে নিয়ে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন তেমনি তার শ্যালক রুহুল্লাহ চৌধুরী ও ভাতিজা আ ন ম সেলিমকে জোরপূর্বক ইউপি চেয়ারম্যান বানিয়েছেন। পিএস এরফানুল করিমকে ভোটার আইডি ট্রান্সফার করে জেলা পরিষদ সদস্য বানান এমপি নদভী। তাদের মাধ্যমেই নির্বাচনি এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেন। কোটি কোটি টাকার সরকারি বরাদ্দের বিলিবণ্টন, প্রকল্প বাস্তবায়নেও অনিয়ম-দুর্নীতির আশ্রয় নেন।
সূত্র জানায়, সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় সবচেয়ে বড় ব্যবসা হচ্ছে ব্রিকফিল্ড বা ইটভাটার ব্যবসা। এখানে দেড় শতাধিক ইটভাটা রয়েছে। চট্টগ্রামে চাহিদার বেশির ভাগ ইটের জোগান আসে এ দুই উপজেলার ইটভাটা থেকে। ইটভাটার মাটি আসে পাহাড় ও কৃষিজমি থেকে। চরতি ও মাদার্শা ইউনিয়ন হচ্ছে পাহাড়ি এলাকা। এ দুই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সংসদ-সদস্য নদভীর দুই স্বজন-ভাতিজা ও শ্যালক। দুই চেয়ারম্যানের ছত্রছায়ায় থেকে দুর্বৃত্তরা এখানকার ছোট-বড় অনেক পাহাড়ের মাটি কেটে সাবাড় করেছে। এছাড়া কেরানিহাটের দুই পাশে বিলের পর বিলের কৃষিজমি দেখতে দিঘির মতো দেখায়। মূলত এসব কৃষিজমির টপ সয়েলসহ মাটি কেটে সরবরাহ দেওয়া হয় ইটভাটায়। ভূমি মালিক কিংবা পাহাড় মালিকদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করেই পেশিশক্তির প্রভাব খাটিয়ে মাটি কাটা ও পাহাড় কাটা হয় সমানে। কেউ বাধা দিতে গেলেই হামলা-মামলার শিকার হতে হয়। তাদের আরেক ব্যবসা ছিল শঙ্খ ও ডলু খালের বালু। কখনো ইজরাবিহীনভাবে কখনো এক জায়গার ইজারা নিয়ে আরেক জায়গায় বালু উত্তোলন করে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করেন নদভীর স্বজনরা। অনেক ক্ষেত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ড ড্রেজিং করে বালু তুললে তা বিক্রি করে টাকা নিয়ে যায় তাদের সিন্ডিকেট। আবার এই সিন্ডিকেট নিজেরাও ড্রেজার লাগিয়ে বালু তুলে বিক্রি করে। ১০ বছর ধরেই চলেছে বালুমহালে দাপট। জানা যায়, ২০২১ সালে ফসলি জমির ওপর দিয়ে অবৈধ বালু উত্তোলনের পাইপ নিতে বাধা দেওয়ায় নিরীহ কৃষকদের ওপর স্বয়ং সংসদ-সদস্যের শ্যালক রুহুল্লাহ চৌধুরীর নেতৃত্বে গুলি ও হামলা চালানো হয়। হামলার শিকার লোকজন মামলাও করতে পারেননি তখন। তবে পাহাড় কাটার অভিযোগে পরিবেশ অধিদপ্তরের মামলার আসামি হয়েছিলেন সংসদ-সদস্যের ভাতিজা ইউপি চেয়ারম্যান আ ন ম সেলিম। সবশেষ সাতকানিয়ার এওচিয়া ৬নং ওয়ার্ড এলাকায় ‘এসএমবি’ নামে একটি ব্রিকফিল্ড দখলের ঘটনা ঘটে। এখান থেকে ছয় লাখ ইট লুট করা হয়। একই ইউনিয়নে কামরুল ইসলাম নামে এক স্থানীয় বাসিন্দাকে গুলি করতে গেলে রাফি নামে এক শিশু গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। এসএমবি ব্রিকফিল্ডের মালিক দাবিদার কামাল উদ্দিনের স্ত্রী তখন সংবাদ সম্মেলন করে তাদের ব্রিকফিল্ড দখলে সংসদ-সদস্যের ইন্ধন রয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে (পিআইও) নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সংসদ-সদস্যের পিএস এরফানুল করিম চৌধুরীর মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার বরাদ্দ বিলিবণ্টন করা হয়। সোলার প্যানেল স্থাপন, টিআর-কাবিখার মাধ্যমে অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন এককভাবেই নিয়ন্ত্রণ করেন সংসদ-সদস্য। লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে স্থাপিত অধিকাংশ সোলার প্যানেল স্বল্পসময়ে অকেজো হয়ে পড়ে। সরকারের প্রদত্ত দরের এক-তৃতীয়াংশ কমে নিুমানের সোলার প্যানেল স্থাপন করে বিপুল অর্থ লোপাট করা হয়।
সূত্রের অভিযাগ, ২০১৯ সালে সংসদ-সদস্যের নানাভাবে হস্তক্ষেপ এবং প্রতিপক্ষকে পেশিশক্তি দিয়ে ঘায়েল করে ভাতিজা আ ন ম সেলিমকে মাদার্শা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বানান। এই ইউনিয়নে নজরুল ইসলাম সিকদার নির্বাচন করবেন ঘোষণা দেওয়ায় তার ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়। একইভাবে শ্যালক রুহুল্লাহ চৌধুরীকে চরতি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত করার জন্যও নগ্ন হস্তক্ষেপ করেন সংসদ-সদস্য। অবৈধ অস্ত্র হাতে সাবেক জামায়াত ক্যাডার রুহুল্লাহর ছবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। তৃতীয় দফায় এমপি নির্বাচিত হওয়ার জন্য এমন উদগ্রীব হয়েছিলেন যে, তাকে একটি অডিওতে বলতে শোনা যায়, আওয়ামী লীগের নমিনেশনের জন্য কেউ ১০০ কোটি টাকা খরচ করলে তিনি প্রয়োজনে এক হাজার কোটি টাকা খরচ করবেন।
এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর দুই মেয়াদে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী তার সম্পদ তিনগুণ বেড়েছে। একইভাবে তার স্ত্রী রিজিয়া রেজা চৌধুরীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বাড়ে সাড়ে তিনগুণ।
২০১৮ সালে আবু রেজা ৭৮ লাখ টাকা মূল্যের একটি গাড়ির মালিক থাকলেও ২০২৩ সালে এসে তিনি তিনটি গাড়ির মালিক বনে যান। এসব গাড়ির মূল্য প্রায় দুই কোটি টাকা। এই সময়ে তার স্ত্রীর ব্যাংকে নগদ টাকা দেখানো হয় ২০ লাখ। আইআইইউসি বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান, সংসদ-সদস্য হিসাবে পাওয়া সম্মানি এবং বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করার সম্মানি হিসাবে পাওয়া অর্থ থেকেই সম্পদের মালিক হন বলে হলফনামায় উল্লেখ করেন নদভী। অভিযোগ আছে, বিধিবহির্ভূতভাবে বেসরকারি আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (আইআইইউসি) ব্যাংক হিসাব থেকে লাখ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন নদভী ও তার স্ত্রী রিজিয়া রেজা চৌধুরী। এই অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের অনুসন্ধানের পাশাপশি নদভী দম্পতিকে শোকজ করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।
সাবেক এমপি নদভী একদিনের রিমান্ডে : বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আইডিয়াল কলেজ শিক্ষার্থী খালিদ হাসান হত্যা মামলায় চট্টগ্রাম-১৫ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য আবু রেজা মুহাম্মদ নদভীর একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। সোমবার শুনানি শেষে ঢাকার মহানগর হাকিম মোস্তাফিজুর রহমান এ আদেশ দেন। নদভী চট্টগ্রামের লোহাগাড়া-সাতকানিয়া আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ-সদস্য ছিলেন। এর আগে রোববার রাতে ঢাকার উত্তরা থেকে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় নদভীকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
আদালত সূত্রে জানা যায়, সোমবার তাকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক সাজ্জাদ হোসেন। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারজানা ইয়াসমিন রাখি রিমান্ড বাতিল করে জামিনের আবেদন করেন। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষও রিমান্ড মঞ্জুরের আবেদন করেন। শুনানি শেষে আদালত একদিনের রিমান্ডের আদেশ দেন।