Logo
Logo
×

শেষ পাতা

দ্রোহ ও ভালোবাসার কবি হেলাল হাফিজ না ফেরার দেশে

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দ্রোহ ও ভালোবাসার কবি হেলাল হাফিজ না ফেরার দেশে

‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ এই পৃথিবীর প্রেম আর সব যুদ্ধ সাঙ্গ করে চিরবিদায় নিলেন দ্রোহ আর প্রেমের কবি হেলাল হাফিজ (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। শুক্রবার তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে চিরকুমার এ কবির বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। সংসারবিমুখ কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কেটেছে রাজধানীর শাহবাগের সুপার হোম নামের একটি হোস্টেলে।

জানা যায়, কবি হেলাল হাফিজ দীর্ঘদিন চোখের রোগ গ্লুকোমায় আক্রান্ত ছিলেন। এছাড়া কিডনি জটিলতা, ডায়াবেটিস ও স্নায়ু রোগে ভুগছিলেন। শুক্রবার দুপুরে হোস্টেলের বাথরুমে পড়ে গিয়ে তার রক্তক্ষরণ হয়। পাশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

বিএসএমএমইউ পরিচালক (হাসপাতাল) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজাউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আনুমানিক দুপুর ২টা ৩৫ মিনিটে কবিকে হাসপাতালে আনা হয়েছিল। ওই সময় ডা. জোনায়েদ নামে একজন চিকিৎসক ডিউটিতে ছিলেন। হাসপাতালে আনার আগেই তার মৃত্যু হয়। চিকিৎসা পরিভাষায় যকে ব্রট ডেড বলা হয়।

তিনি আরও জানান, ‘ওনাকে (কবি হেলাল হাফিজ) কয়েকজন ব্যক্তি নিয়ে আসেন মৃত অবস্থায়। বিষয়টি আমি শাহবাগ থানার ওসিকে জানানোর পর ওসি দ্রুত এসে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ফরমালিটিজ সারেন।’ তাকে বারডেমের হিমঘরে রাখা হয়েছে।

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি হাসান হাফিজ ও সাধারণ সম্পাক আইয়ুব ভূঁইয়া এক যৌথ বিবৃতি জানিয়েছেন, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সিনিয়র সদস্য কবি হেলাল হাফিজের জানাজা শনিবার (আজ) বাদ জোহর প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হবে। এরপর বাংলা একাডেমিতে আরেকটি জানাজা এবং সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা শেষে কবির দেশের বাড়ি নেত্রকোনায় দাফন করার পরিকল্পনা রয়েছে।

এদিকে কবি হেলাল হাফিজের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখপ্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, দ্রোহ ও প্রেমের কবি হেলাল হাফিজের মৃত্যু বাংলা ভাষা ও সাহিত্যাঙ্গনের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। কবি হেলাল হাফিজ ছিলেন তারুণ্যের শক্তি এবং স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক সাহসী কণ্ঠ। তার কালজয়ী কবিতার মতোই তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে।

কবি হেলাল হাফিজের জন্ম ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলার বড়তলী গ্রামে। তার বাবার নাম খোরশেদ আলী তালুকদার, মায়ের নাম কোকিলা বেগম। তার শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য কেটেছে নিজের শহরেই। তিনি ১৯৬৫ সালে নেত্রকোনা দত্ত হাইস্কুল থেকে এসএসসি (মাধ্যমিক) এবং ১৯৬৭ সালে নেত্রকোনা কলেজ থেকে এইচএসসি (উচ্চমাধ্যমিক) পাশ করেন। ওই বছরই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ছাত্রাবস্থায় ১৯৭২ সালে তিনি তৎকালীন দৈনিক পূর্বদেশে সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন দৈনিক পূর্বদেশের সাহিত্য সম্পাদক। ১৯৭৬ সালের শেষদিকে তিনি দৈনিক দেশ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক পদে যোগদান করেন। তিনি দৈনিক যুগান্তরের শুরু থেকে দীর্ঘদিন সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

জানা যায়, কবি হেলাল হাফিজ তিন বছর বয়সে মাকে এবং বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সময় বাবাকে হারান। ১৯৭৩ সালে কবির পছন্দের একজন অন্যত্র বিয়ে করায় তিনি আর বিয়ে করেননি। আজীবন তিনি সংসারবিমুখ ছিলেন।

উত্তাল ষাটের দশক ছিল তার কবিতার উপকরণ। ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানের সময় রচিত ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতা তাকে কবিখ্যাতি এনে দেয়। তার কবিতা হয়ে ওঠে মিছিলের স্লোগান। ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ কালজয়ী কবিতার এ লাইন দুটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। পরবর্তী সময়ে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময়ও কবিতাটি মানুষের মাঝে তুমুল সাড়া জাগায়।

১৯৮৬ সালে প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কবিকে নিয়ে যায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এরপর বইটির ৩৩টির বেশি সংস্করণ বেরিয়েছে। কেবল কবিতার পাঠকের নিরিখে নয়, যে ব্যক্তি খুব একটা সাহিত্যের খোঁজও করেন না, এমন অনেকের হৃদয়েও দোলা দিয়েছে হেলাল হাফিজের পঙ্ক্তি। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থভুক্ত প্রতিটি কবিতার শেষে উল্লিখিত তারিখ অনুযায়ী কবিতাগুলো লেখা হয়েছে ১৯৬৯ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে।

দীর্ঘসময় নিজেকে অনেকটা আড়ালে সরিয়ে নিয়েছিলেন হেলাল হাফিজ। আড়াই দশক পর ২০১২ সালে তিনি পাঠকদের জন্য আনেন দ্বিতীয় বই ‘কবিতা একাত্তর’। তৃতীয় এবং সর্বশেষ বই ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে।

লড়াইয়, সংগ্রাম, প্রেম-বিরহ, দ্রোহে যাপিত জীবনের পরতে পরতে হেলাল হাফিজ স্পর্শ দিয়ে গেছেন। ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’র মতো ‘অগ্ন্যুৎসব’ কবিতাও শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আগুন জ্বেলে দেয়। এ কবিতায় কবি বলেছেন, ‘ছিল তা এক অগ্ন্যুৎসব, সেদিন আমি/ সবটুকু বুক রেখেছিলাম স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রে? জীবন বাজি ধরেছিলাম প্রেমের নামে/ রক্তঋণে স্বদেশ হলো,/ তোমার দিকে চোখ ছিল না/ জন্মভূমি সেদিন তোমার সতীন ছিলো।’

কেবল মুক্তিযুদ্ধ কিংবা গণ-অভ্যুত্থানের মতো প্রেক্ষাপটে নয়, যেকোনো অন্যায়ে-শোষণে-অবিচারে হেলাল হাফিজের এ উচ্চারণ সবার হয়ে ওঠে। সমালোচকদের বিচারে অবস্থান যেখানেই হোক না কেন, জনপ্রিয়তার বিচারে বাংলাদেশের শীর্ষ কবিদের সারিতেই থাকবে তার নাম।

তিনি ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন। এছাড়া কবিতার জন্য তিনি পেয়েছেন নারায়ণগঞ্জ বৈশাখী মেলা উদ্?যাপন কমিটির কবি সংবর্ধনা (১৯৮৫), যশোহর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (১৯৮৬), আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৭), নেত্রকোনা সাহিত্য সমাজ, কবি খালেদদাদ চৌধুরী সাহিত্য পদক সম্মাননা, বাসাসপ কাব্যরত্ন ২০১৯ প্রভৃতি।

নেত্রকোনায় শোকের ছায়া : নেত্রকোনা প্রতিনিধি জানান, কবি হেলাল হাফিজের মৃত্যুতে নেত্রকোনার সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। শুক্রবার দুপুরে তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে নানান স্মৃতিচারণ করে কবিকে স্মরণ করছেন তার স্বজন, সহপাঠী ও অগণিত ভক্ত।

নেত্রকোনারই এক নারীর সঙ্গে কৈশোর থেকে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় ওই নারীকে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দেন তার মা-বাবা। এ কারণে আজীবন বিরহ-যন্ত্রণাকে লালন করে বেঁচেছিলেন কবি। এ কারণে জন্মভূমি নেত্রকোনার প্রতিও ছিল তার প্রচ্ছন্ন অভিমান।

৫০ বছরে মাত্র তিনবার তিনি নেত্রকোনায় এসেছেন। সবশেষ এসেছিলেন ২০১৯ সালে নেত্রকোনার বসন্তকালীন সাহিত্য উৎসবে, খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার গ্রহণ করতে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী যৌবনে কবির ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। তিনি বলেন, ‘ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে রচিত কবির নিষিদ্ধ সম্পাদকীয় (এখন যৌবন যার) কবিতাটি বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে আমাদের ব্যাপক অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।’

নেত্রকোনা সাহিত্য সমাজের সাধারণ সম্পাদক কবি তানভীর জাহান চৌধুরী বলেন, ‘জীবদ্দশায় কবি তার সঠিক সম্মান রাষ্ট্র বা সমাজ থেকে পাননি।’

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম