১৬ ডিসেম্বর বিআরটি প্রকল্পের উদ্বোধন
বিশেষায়িত বাস ছাড়া সুফল নিয়ে শঙ্কা
ছবি: সংগৃহীত
বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত ২০.৫০ কিলোমিটার করিডরে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে ১৬ ডিসেম্বর। তবে পুরো কাজ শেষ না করে ত্রুটিপূর্ণ নকশায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ায় বিশেষায়িত বাস আনার পরও কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলবে না মলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অনেক ক্ষেত্রে ওই সড়কের সংকট বাড়ারও শঙ্কা রয়েছে। ফলে ভেবেচিন্তে এই সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে, মন্তব্য তাদের। তারা বলেন, এ সরকারের ভালো ইমেজ রয়েছে। আমলাদের পরামর্শে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিলে তা সরকারের জন্য সুখকর হবে না। নির্দিষ্ট লেনে বিশেষায়িত বাস ছাড়া বিআরটি প্রকল্পের সুফল মিলবে না জানিয়ে গণপরিবহণ বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ প্রকল্পে সুফলের পরিবর্তে দুর্ভোগ বাড়াবে এবং বিশ্বজুড়ে সমাদৃত এ ধারণাটি বাংলাদেশে নেতিবাচক উপস্থাপন হবে।
মেট্রোরেলের মতো আরেক গণপরিবহণ সেবার নাম বিআরটি। বিশ্বজুড়ে বিআরটি প্রকল্পের বাসগুলো দ্রুতগতির হয়ে থাকে। সেখানে অন্য কোনো পরিবহণ চলাচল করে না। সংশ্লিষ্টরা বলেন, সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব বিআরটিসির বাস দিয়ে বিআরটি সেবা চালু করার ঘোষণা দিয়েছেন, যা অবৈজ্ঞানিক। বিশেষায়িত বাস সার্ভিস আসার আগ পর্যন্ত তারা এ বাস সার্ভিসের নাম দিতে পারেন স্বতন্ত্র বাস সার্ভিস।
প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, সড়ক বিভাজক, ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ এবং বাস কেনার কাজ বাকি রয়েছে। এছাড়াও বিআরটি স্টেশেনের কিছু ফিনিশিং কাজও বাকি রয়েছে। এ অবস্থায় ১০টি এসি বাস দিয়ে বিআরটির জন্য নির্মিত নির্দিষ্ট লেনে বাস চলাচল শুরু করা হচ্ছে। আপাতত বিআরটিসির বাস ও প্রাইভেট কার চলবে এই লেনে। তবে সেখানে অন্য কোনো বাস চলাচল করবে না। তবে চলতি সপ্তাহ থেকে পরীক্ষামূলকভাবে নির্দিষ্ট লেনে অন্যান্য বাস ও প্রাইভেট কারের সঙ্গে বিআরটিসির বাসগুলো চলাচল করছে। সব আয়োজন সম্পন্ন না করে বাস চালু করায় যাত্রীরা নানা ধরনের ভোগান্তিতে পড়ছেন। সংশ্লিষ্টরা বলেন, ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের যাত্রীদের যানজটের ধকলে পড়ে সৃষ্ট দুর্ভোগ থেকে বাঁচাতে এবং দ্রুত চলাচল নিশ্চিত করতে বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এখন প্রকল্পের প্রায় ৯৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ জুনের মধ্যে শেষ হবে। তখন নগরবাসী পুরোপুরি বিআরটির কাঙ্ক্ষিত সুফল দেখতে পাবে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, যানজট নিরসনের কথা বলে ২০১২ সালে বিআরটি প্রকল্পের কাজ হাতে নেওয়া হয়। বাস্তবায়নে মন্থরগতির কারণে এই করিডরের যাত্রীদের বছরের পর বছর সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে দুর্ঘটনায় অন্তত ছয়জন নিহত হওয়া ছাড়াও প্রকল্পের অব্যবস্থাপনা নিয়েও গাজীপুরের মানুষ বারবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তড়িঘড়ি করে সরকার এখন বিআরটি করিডরে বিশেষায়িত বাস ছাড়া বিআরটিসির এসি বাস চলাচল করলেও অনেক ক্ষেত্রে সমস্যা থেকে যাবে। যে কয়েকটি ফুটওভার ব্রিজ চালু করা হয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। আরও অতিরিক্ত ১০টি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হবে বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত। এ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য-১০০টি আর্টিকুলেটেড বাসের মাধ্যমে প্রতি ঘণ্টায় ২৫ হাজার মানুষ চলাচল করানো এবং এর মাধ্যমে ঢাকা-ময়মনসিংহ করিডরের যানজট কমানো।
এলাকাবাসী জানান, নির্দিষ্ট করিডরে বিআরটির বাস নির্বিঘ্নে চলাচল করলেও ওই করিডরে যানজট বাড়বে। জলাবদ্ধতা দেখা দেবে। পথচারী হাঁটার ফুটপাত সংকুচিত হওয়ায় তারা সড়কে চলতে বাধ্য হবেন; এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়বে।
তারা আরও জানান, বিআরটি বাসের যে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অনেকাংশে বেশি। বিআরটির নির্ধারিত ভাড়া তালিকায় বলা হয়েছে, গাজীপুর নগরীর শিববাড়ী থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত ২০, বোর্ডবাজার ৩৫, টঙ্গীর কলেজ গেট ৫০ এবং বিমানবন্দর ৭০ টাকা। ফিরতি পথে বিমানবন্দর থেকে কলেজ গেট ২৫, বোর্ডবাজার ৪০, চৌরাস্তা ৫৫ এবং শিববাড়ি ৭০ টাকা।
বিআরটি প্রকল্পের রুট : বিমানবন্দর টার্মিনাল, জসিমউদ্দিন সরণি, আজমপুর, হাউজবিল্ডিং, আব্দুল্লাহপুর, টঙ্গী ব্রিজ, স্টেশন রোড, মিলগেট, চেরাগআলী মার্কেট, টঙ্গী কলেজ, হোসেন মার্কেট (এরশাদনগর), গাজীপুরা, তারগাছ, বড়বাড়ী বাজার, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বোর্ডবাজার, হাজীর পুকুর, মালেকের বাড়ি, ভোগরা দক্ষিণ, ভোগরা উত্তর, চৌরাস্তা, বিআরটিসি ডিপো, আড়ং মিল্ক ফ্যাক্টরি, কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও গাজীপুর টার্মিনাল।
বিশেষজ্ঞ অভিমত : এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক এবং যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. সামছুল হক যুগান্তরকে জানান, নির্দিষ্ট লেনে বিশেষায়িত বাসের মাধ্যমে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পে বাস চালু করতে হয়। কিন্তু বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর করিডরের বিআরটি প্রকল্পের নির্দিষ্ট লেনে প্রাইভেট কারের চলাচল বহাল রেখে বিশেষায়িত বাস ছাড়াই বিআরটিসির বাস দিয়ে বিআরটি সেবা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটি হাস্যকর ও অবৈজ্ঞানিক। এ কাজের মাধ্যমে পৃথিবীজুড়ে সমাদৃত বিআরটি বিষয়ে বাংলাদের মানুষ ভুল ধারণা পোষণ করবে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারকে ইতিবাচক সরকার বলা যায়। তারা আগেকার সরকারের মতো কিছু করছে না। এ সময়ে আমলাদের কথায় অবৈজ্ঞানিক এ কাজ সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। সরকার যদি বিআরটিসি বাস দিয়ে পরীক্ষামূলক বিআরটির নির্দিষ্ট লেন ব্যবহার করতে চায়, তাহলে এর নাম দিতে পারে স্বতন্ত্র বাস সার্ভিস। এতে বৈজ্ঞানিক স্বীকৃত ও সমাদৃত বিআরটি ধারণাটির অন্তত ইজ্জত রক্ষা হবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান যুগান্তরকে বলেন, নির্দিষ্ট লেনে মানসম্মত বাস দিয়ে বিআরটি সার্ভিস চালু করতে হয়। এ প্রকল্প ত্রুটিপূর্ণ নকশায় বাস্তবায়ন হয়েছে। এরপরও যেহেতু নির্মিত হয়েছে, বিশেষায়িত বাস দিয়ে চালু হলে সেটি ইতিবাচক হতো।
তিনি বলেন, গাজীপুর থেকে উত্তরা পর্যন্ত নির্বিঘ্নে এসে আবারও যাত্রীদের যানজটের ধকলে পড়তে হবে। তাহলে এ প্রকল্প থেকে কাঙ্ক্ষিত সুফল তো মিলল না। এখন গাজীপুর থেকে বিআরটিসির বাস বিআরটি হয়ে গুলিস্তান পর্যন্ত চলাচল করবে। যাত্রীরা একাংশে নির্বিঘ্নে এসে বাকি অংশে যানজটের ধকলে পড়বে। তাতে সুবিধা কি হলো। ঢাকা-গাজীপুর বিআরটি প্রকল্পটি জগাখিচুড়ির প্রকল্প হয়েছে। বিআরটির নামে কার্যত ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. এহছানুল হক শনিবার সাংবাদিকদের জানান, বিআরটি প্রকল্পে অনেক টাকাপয়সা খরচ হয়েছে, অনেক সময়ও নষ্ট হয়েছে। বহুদিন ধরে মানুষ এর প্রতীক্ষায় আছে। এর একটা অবসান হওয়া উচিত। প্রাথমিকভাবে দুটি এসি বাস দিয়ে পরীক্ষামূলক যাত্রী পরিবহণ করা হচ্ছে। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে বিআরটি প্রকল্পের বাস চলাচলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে।
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ১ ডিসেম্বর একনেকে বিআরটি প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। তিনদফা সংশোধনের পর প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি ৩২ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে কাজ শেষ করার সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেটিও হয়নি। সবশেষ বলা হয়েছিল, চলতি বছরের আগস্টে কাজ শেষ হবে। পরে সরকার আবার ডিসেম্বরে উদ্বোধনের কথা জানায়। এর মধ্যে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চলাকালে বিআরটি প্রকল্পে ভাঙচুর হয়। ফলে প্রকল্প উদ্বোধন নিয়ে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। তবে প্রকল্প পুরোপুরি কাজ শেষ ও সুফল পেতে অপেক্ষা করতে হবে জুন পর্যন্ত।