Logo
Logo
×

শেষ পাতা

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস আজ

গুমে জড়িতদের বিচার সংশোধিত আইনে

আবদুল্লাহ আল মামুন

আবদুল্লাহ আল মামুন

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গুমে জড়িতদের বিচার সংশোধিত আইনে

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গুম-খুনসহ গুরুতর অপরাধ বিচারে উদ্যোগী হয় অন্তর্বর্তী সরকার। শেখ হাসিনার দেড় দশকের বেশি সময়ের শাসনামলে হওয়া গুমের সুষ্ঠু বিচারে ‘গুম তদন্ত কমিশন’ গঠনসহ পুরোনো আইনেরও সংশোধন করা হয়েছে। নবগঠিত কমিশনে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত জমা পেড়েছে এক হাজার ৬০০টি অভিযোগ। সংশোধন হওয়া নতুন আইনে গুমের সঙ্গে জড়িতদের যথাযথ বিচার করা সম্ভব বলে মনে করছেন আইনসংশ্লিষ্টরা।

আজ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে-‘আমাদের অধিকার, আমাদের ভবিষ্যৎ, এখনই’। দিবসটি উপলক্ষ্যে খোঁজখবর নিতে গিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে। গুমের শিকার পরিবারের সদস্যদের সংগঠন মায়ের ডাক, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ও একাধিক সংগঠন দিবসটি ঘিরে নানা কর্মসূচির উদ্যোগ নিয়েছে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে গুম, খুন ও জুলাই গণহত্যাসহ আওয়ামী ফ্যাসিবাদী জুলুমের প্রতিবাদ ও জড়িতদের বিচারের দাবিতে গণজমায়েত করবে ভুক্তভোগীরা। মায়ের ডাকের আহ্বানে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দুপুর ১টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত এ গণজমায়েত হবে।

ভুক্তভোগী ও মানবাধিকারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আওয়ামী লীগের শাসনজুড়ে দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শীর্ষে ছিল গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। বিরোধী মত দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে ‘আয়না ঘরে’ রেখে করা হতো নিষ্ঠুর নির্যাতন। গুম হওয়াদের মধ্যে বিএনপি, জামায়াত ও সমমনাসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন সরকারের সমালোচনাকারী নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। বিভিন্ন সময়ে গুমের শিকার অনেকে বাড়ি ফিরে লোমহোর্ষক নির্যাতনের কথা জানিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত কত মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন, কতজন ছাড়া পেয়েছেন এবং কতজন নিখোঁজ আছেন-তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থার কাছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এ সংখ্যা ৭০০’র কাছাকাছি।

আইন ও মানবাধিকারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের গুমের অভিযোগ পুরোনো হলেও ২০১২ সালে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পর বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। তবে তৎকালীন সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে গুমের বিষয়টি সবসময় অস্বীকার করা হয়েছে। সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে বিষয়টি নিয়ে তামাশামূলক নানা মন্তব্যও করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের (এএইচআরসি) ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে ৬২৩ ব্যক্তি গুমের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৮৪ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। জীবিত অবস্থায় ফিরে এসেছেন বা পরবর্তী সময়ে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে ৩৮৩ জনকে। আর তিনজনের বিষয়ে কোনো তথ্য জানা যায়নি। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ১৫৩ ব্যক্তি। বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর তথ্যমতে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের গত দেড় দশকের শাসনামলে ৬৭৭ জন গুমের শিকার হন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯৮ জন গুমের শিকার হন ২০১৮ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর। সংস্থাটির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২০ জন গুমের শিকার হন। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৮ সাল থেকে ২২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে মাত্র ৬০ জন গুমের শিকার হয়ে সংস্থাটিতে অভিযোগ করেছেন। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্যে দেখা যায়, ২০০৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশে গুমের শিকার হয়েছেন ২৫৫ জন। অন্যদিকে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-২০২৩ সাল পর্যন্ত ২৬০ জন গুমের শিকার হয়েছেন, যাদের মধ্যে ১৯২ জন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।

সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশে ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতাহীনদের জুলুম, নির্যাতন ও গুম-খুনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘন করে থাকে। বর্তমানেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটছে। মানুষের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষায় এ ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

মায়ের ডাক-এর সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, গুম হওয়া মানুষগুলো কোথায় আছেন, তার কোনো স্পষ্ট উত্তর আগের সরকার দেয়নি। এমনকি তাদের নিয়ে ঠাট্টা পর্যন্ত করেছে। তিনি বলেন, আমাদের বর্তমানে চাওয়া হলো, এখন পর্যন্ত যাদের গুম করা হয়েছে, তাদের যেন ফেরত দেওয়া হয়। একই সঙ্গে প্রতিটি গুমের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা হোক।

গুম কমিশনে ১৬শ অভিযোগ : অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০তম দিন উপলক্ষ্যে ১৭ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছিলেন, এ পর্যন্ত এক হাজার ৬০০ গুম হওয়া মানুষের তথ্য পেয়েছে গুমের তদন্তে গঠিত কমিশন। বিগত আওয়ামী লীগ শাসন আমলে গুম হওয়া মানুষের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে।

এদিকে, গত ৫ নভেম্বর রাজধানীর গুলশানে এক সংবাদ সম্মেলনে গুম কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী জানান, অভিযোগের মধ্যে ৩৮৩টি গুমের অভিযোগ যাচাই বাছাই করেছে কমিশন। এগুলোর মধ্যে র‌্যাবের বিরুদ্ধে ১৭২টি, সিটিসির বিরুদ্ধে ৩৭টি, ডিবির বিরুদ্ধে ৫৫টি, ডিজিএফআইয়ের বিরুদ্ধে ২৬টি, পুলিশের বিরুদ্ধে ২৫টি এবং অন্যদের বিরুদ্ধে ৬৮টি গুমের অভিযোগ জমা পড়েছে।

কমিশন প্রধান আরও বলেন, অভিযোগের তদন্তে গিয়ে এসব বাহিনীর আটটি গোপন বন্দিশালা পেয়েছে কমিশন। যেখানে বছরের পর বছর এসব গুম হওয়া ব্যক্তিকে রেখে নির্যাতন করা হতো। এসব গুমের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাত সদস্যকে ডাকা হয়েছে, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পর্যায়ক্রমে অভিযুক্ত অন্যদেরও ডাকা হবে।

সংশোধিত আইনে বিচার সম্ভব : অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে গুম প্রতিরোধে আইন করার কথা জানিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে আগের আইনটির কিছুটা সংশোধন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম সোমবার যুগন্তরকে কলেন, আগের আইনে গুমের অপরাধটি অ্যাবডাকশন, কনফাইনমেন্ট ও ইমপিরিসনমেন্টসহ একসঙ্গে সংজ্ঞায়িত ছিল। বর্তমানে বিষয়টি স্পষ্ট করে ‘এনফোর্স ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’ তথা গুম শব্দটি যুক্ত করে সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। ফলে নতুন আইনে গুমের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের যথাযথভাবে বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণজমায়েত : আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষ্যে গণহত্যা, জোরপূর্বক গুম, ক্রসফায়ার, পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু, পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বর গণহত্যা, মোদিবিরোধী আন্দোলন, ডিএসএসহ বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী জুলুমের প্রতিবাদে ভুক্তভোগী গণজমায়েত অনুষ্ঠিত হবে আজ মঙ্গলবার। সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এ অনুষ্ঠানে হাজির হতে আহ্বান জানিয়ে মায়ের ডাকের সভাপতি হাজেরা খাতুন বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এসে তাদের অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণ এবং বিচারের দাবিতে একাত্মতা প্রকাশ করবেন।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম