কিডনি ডায়ালাইসিসে রোগী সর্বস্বান্ত
মাসে গুনতে হচ্ছে ২ লক্ষাধিক টাকা, কিডনি ডায়ালাইসিসে রোগী সর্বস্বান্ত
বিআইডিএস-এর গবেষণা প্রতিবেদন: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮ দশমিক ২৪ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট বেকার, নারী বেকারত্বের হার বেশি
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কিডনি রোগে আক্রান্ত রোগী ডায়ালাইসিস করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। একজন রোগীকে ডায়ালাইসিস করাতে প্রতিমাসে গুনতে হচ্ছে সর্বোচ্চ ২ লাখ ১০ হাজার টাকা। এছাড়া সর্বনিম্ন ব্যয় হয় ৬ হাজার ৬৯০ টাকা। তবে অসংক্রামক রোগের কারণে সব শ্রেণির মানুষ মিলে গড়ে পকেট থেকে খরচ করতে হয় মোট আয়ের ৮৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) বার্ষিক গবেষণা সম্মেলনের তৃতীয় দিন সোমবার এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ‘আউট অব পকেট কস্ট অব কিডনি ডায়ালাইসিস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণাপত্রটি উপস্থাপন করেন বিআইডিএস-এর গবেষণা ফেলো ড. আব্দুর রাজ্জাক সরকার। এ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ইউসিএসআই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি ভাইস চ্যান্সেলর এ কে এনামুল হক।
এদিকে পৃথক গবেষণায় বলা হয়েছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮ দশমিক ২৪ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট বেকার এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা লেগেছে দেশের অর্থনীতিতে। তৃতীয় দিনের শুরুতেই বক্তব্য দেন বিআইডিএস-এর মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন।
গবেষণায় বলা হয়েছে, মানুষের পকেট থেকে যে টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে, এর মধ্যে শুধু ডায়ালাইসিস ফি দিতেই মাসে খরচ হয় ৪৫৮ টাকা থেকে ৭৮ হাজার টাকা। এছাড়া ডায়ালাইসিসের সঙ্গে যুক্ত আরও প্রায় ৬ ধরনের সরাসরি মেডিকেল চিকিৎসাসংক্রান্ত খরচ হয় ৪ হাজার ২৮০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ২ লাখ ২ হাজার ৮০০ টাকা। অপরদিকে কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিস করাতে ৬ ধরনের নন মেডিকেল খরচ হয় শূন্য থেকে ৯২ হাজার ৬০০ টাকা।
গবেষণায় আরও বলা হয়, ডায়ালাইসিসের মধ্যে মোট মাসিক যে খরচ হয়, এর মধ্যে ৩৫ দশমিক ২৮ শতাংশ ডায়ালাইসিস ফিতে যায়। এছাড়া কনসালটেশন ফি ২ দশমিক ৪১, ওষুধ কিনতে ২২ দশমিক ৮৭ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ১০ দশমিক ০১ শতাংশ। আরও আছে বেড ফি ২ দশমিক ৪৯, মেডিকেল ইক্যুইপমেন্ট খরচ ৪ দশমিক ০৪ এবং অন্যান্য খাতে খরচ হয় ১ দশমিক ৭০ শতাংশ। নন-মেডিকেল খরচের মধ্যে ডায়ালাইসিসে খরচ হয় যাতায়াতে ৮ দশমিক ৫৩, খাদ্যে ২ দশমিক ৭৪ এবং ঘুস দিতে যায় শূন্য দশমিক ১২ শতাংশ।
গবেষণায় বলা হয়েছে, ওয়েলথ ইনডেক্স অনুযায়ী অসংক্রামক স্বাস্থ্য ব্যয়ের মধ্যে কিডনি ডায়ালাইসিসে একজন রোগীর পকেট থেকে খরচ হয় মোট আয়ের ২৫ শতাংশ। এছাড়া মোট খাদ্যবহির্ভূত ব্যয়ের ৪০ শতাংশই যায় নিজের পকেট থেকে। এক্ষেত্রে অতিদরিদ্রদের পকেট থেকে খরচ হয় মোট আয়ের ৯২ দশমিক ৭১ শতাংশ, গরিবদের ৮৯ দশমিক ৪৭, মধ্য-আয়ের মানুষের ৯২ দশমিক ৫৫, ধনীদের ৮৪ দশমিক ৩৮ এবং অতিধনীদের ৮৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। গবেষণাপত্র উপস্থাপনের সময় বলা হয়, কিডনি ডায়ালাইসিস হলো একটি প্রসেস বা প্রক্রিয়া। মানুষের শরীরে যখন কিডনি কাজ করে না, তখন অনেক ধরনের বর্জ্য পদার্থ জমে যায়। সেজন্য কিডনির বিকল্প হিসাবে বর্জ্যগুলো পরিশোধিত করার যে প্রক্রিয়া, সেটিকে ডায়ালাইসিস বলে। অর্থাৎ কিডনির বিকল্প হচ্ছে ডায়ালাইসিস। আরও বলা হয়েছে, কিডনি ডায়ালাইসিসেস চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে একজন উত্তরদাতা বলেছিলেন, কিডনি নষ্ট হওয়ার সঙ্গে সবসময় ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপের সমস্যা থাকে, যার নিজস্ব চিকিৎসা এবং সংশ্লিষ্ট আলাদা খরচ থাকে। এগুলো মেটানো প্রায় অসাধ্য হয়ে পড়ে। আরেকজন উত্তরদাতা বলেন, আমার মানসিক স্বাস্থ্য এবং এ সংক্রান্ত কাউন্সেলিং দরকার হয়। এটি করাতে আলাদাভাবে অনেক টাকা লাগে। এক্ষেত্রে শুধু ধনীরাই এ ধরনের স্বাস্থ্য সেবা নিতে পারেন।
গ্র্যাজুয়েট বেকার ২৮ দশমিক ২৪ শতাংশ : জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ২৮ দশমিক ২৪ শতাংশ। এ গবেষণায় দেখা যায়, পাশ করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধিকাংশই কম আয়ের চাকরিতে নিয়োজিত। নারী এবং গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি। বিআইডিএস-এর গবেষণা পরিচালক এসএম জুলফিকার আলী কলেজ গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে বেকারত্ব নিয়ে করা এ গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন। গবেষণায় অংশগ্রহণকারী কলেজগুলোর মধ্যে ৬০৮টি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন, এর মধ্যে বিআইডিএস ৬১টি কলেজ বেছে নিয়েছে। গবেষণায় ১ হাজার ৩৪০ জন পাশ করা শিক্ষার্থী, ৬৭০ জন অধ্যয়নরত, ৬১ জন কলেজ অধ্যক্ষ এবং ১০০ জন চাকরিদাতা অংশগ্রহণ করেছেন।
গবেষণায় দেখা যায়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্নাতক সম্পন্ন হয় ব্যবসায় শিক্ষা, সমাজবিজ্ঞান ও মানবিক বিষয়ের ওপর, যেখানে বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়ে পাশ করা শিক্ষার্থীদের হার অনেক কম (স্নাতকে ৩ দশমিক ৮২, স্নাতকোত্তরে ৩ দশমিক ১০ শতাংশ)। পাশাপাশি প্রায় ৪২ দশমিক ২৯ শতাংশ শিক্ষার্থী বেতনভোগী চাকরিতে এবং ১৬ দশমিক ২৪ শতাংশ নিজে উদ্যোক্তা হিসাবে কাজ করছেন। বেকারদের মধ্যে নারীর সংখ্যা বেশি এবং গ্রামের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেকারত্বের হারও বেশি। সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে এসএসসি পাশ করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেকারত্বের হার তুলনামূলক বেশি, তবে কারিগরি ও দাখিল শিক্ষায় এ হার কম। গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, পাশ করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৩৬ শতাংশ শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত এবং অনেকেই অফিসার বা অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসারের পদে চাকরি করছেন। সরকারি চাকরি করার ইচ্ছা ৪৩ দশমিক ১৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর। যেখানে অধিকাংশের লক্ষ্য সরকারি চাকরিতে যোগদান করা।
এ গবেষণায় উঠে এসেছে কলেজগুলোর নানা সমস্যা। এর মধ্যে রয়েছে কলেজগুলোর মান কম, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও ইনসেনটিভের অভাব এবং চাকরির বাজারমুখী শিক্ষার অভাব।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা অর্থনীতিতে : রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তবে পেট্রোলিয়াম ও সারে ভর্তুকি দিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সরকার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু খাদ্যপণ্যের দামে এ যুদ্ধের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাজারে বেশকিছু পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের বাজারও হয়েছে অস্থির। এর মধ্যে পেট্রোলিয়ামজাতীয় পদার্থ, ইউরিয়া সার এবং খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এ কারণে দেশে মূল্যস্ফীতিও ঊর্ধ্বমুখী। ‘ইমপ্যাক্টস অব রাশিয়া-ইউক্রেন অয়্যার প্রাইস সকস অব দ্য বাংলাদেশ ইকোনমিক : সিম্যুলেশন ভিএস রিয়েলিটি’ গবেষণাটি উপস্থাপন করেন বিআইডিএস-এর রিসার্চ ফেলো তারিন তারিমা চৌধুরী। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকার ২০২২ সালে ইউরিয়া সারে প্রায় ৪০ বিলিয়ন টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। এদিকে ২০২২ সালের মে থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে যাওয়া সত্ত্বেও চাল, ভুট্টা, ভোজ্য তেলের অভ্যন্তরীণ মূল্য ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যায়। আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম ক্রমাগত বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গমের অভ্যন্তরীণ মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতাও লক্ষ করা যায়। পেট্রোলিয়াম ও সারের দামের বিপরীতে খাদ্যের দাম সরকার নির্ধারণ করে না।