Logo
Logo
×

শেষ পাতা

মানুষের আস্থার জায়গা এখন ডিএমপির ডিবি

ছাত্র-জনতাকে হত্যা মামলায় আসামি গ্রেফতারে শীর্ষে অবস্থান ডিবির * এখন আমার একটাই টার্গেট-অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখা -ডিবিপ্রধান

Icon

ইমন রহমান

প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মানুষের আস্থার জায়গা এখন ডিএমপির ডিবি

ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে প্রভাব পড়ে পুলিশবাহিনীর ওপর। আন্দোলনকারীদের দমনে নির্বিচারে গুলি করে হত্যার জেরে রাজধানীসহ সারা দেশে থানাসহ পুলিশের বিভিন্ন অফিসে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের অনেকে আত্মগোপনে চলে যান। ফলে নিরাপত্তাহীনতায় থাকে পুরো দেশের মানুষ। বেশি সংকটে পড়েন রাজধানীবাসী।

৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে রাত নামলেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দলবেঁধে ডাকাতি সংঘটিত হতে থাকে। বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চুরি, সড়কে ছিনতাই, এমনকি দিনদুপুরে বিভিন্ন দোকানে ডাকাতির ঘটনাও জনমনে উদ্বেগ ছড়ায়। সাধারণ মানুষ কোনো প্রতিকার পাচ্ছিলেন না। এরই মধ্যে দ্রুততম সময়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) বিভিন্ন ইউনিটের পাশাপাশি গোয়েন্দা শাখাকেও (ডিবি) ঢেলে সাজানো হয়। শুরু থেকেই রাজধানীবাসীর নিরাপত্তায় কঠোর অবস্থান নেয় ডিবি। নানা প্রতিকূলতার মাঝেও অপরাধী গ্রেফতারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে ডিবি। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করে রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ডিএমপির অভিযানে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে নানা অপরাধে জড়িত প্রায় পাঁচ হাজার জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে আগস্টে ৯১১, সেপ্টেম্বরে ১ হাজার ১৪২ এবং অক্টোবরে ২ হাজার ৬৬৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এসব আসামির বেশির ভাগই গ্রেফতার করেছে ডিবি পুলিশ। এছাড়াও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ডিএমপির বিভিন্ন থানায় হওয়া হত্যা মামলার আসামি গ্রেফতারে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে ডিএমপির এ ইউনিট। আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট মন্ত্রী-নেতা ও ভিআইপি অনেকে হত্যা মামলার আসামি হয়েও আত্মগোপনে ছিলেন। তাদের অনেককেই খুঁজে বের করে একে একে গ্রেফতার করেছে ডিবি। এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হওয়া ভিআইপিদের প্রায় শতভাগই ডিবির অ্যাচিভমেন্ট।

পুলিশ কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, বাংলাদেশ পুলিশের ক্লিন ইমেজের কর্মকর্তা রেজাউল করিম মল্লিককে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) দায়িত্ব দেওয়ায় এমন সাফল্য এসেছে। ১ সেপ্টেম্বর বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের ১৭তম ব্যাচের এ কর্মকর্তাকে ডিএমপির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট ডিবির দায়িত্ব দেওয়া হয়। দায়িত্ব গ্রহণের পর ডিবি পুলিশকে কলঙ্কমুক্ত করার কাজ শুরু করেন তিনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিতে নিহতের ঘটনায় একের পর এক মামলা হয়। এসব মামলায় আসামি হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার মন্ত্রিসভার সদস্য ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রভাবশালী নেতাকর্মীরা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চ্যালেঞ্জ নিয়েই মামলার আসামিদের গ্রেফতার শুরু করে ডিবির একাধিক টিম। নানা চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে পুলিশের সাবেক আইজিপি শহিদুল হক, আব্দুল্লাহ আল মামুন, হেভিওয়েট নেতা আমির হোসেন আমু, কামরুল ইসলাম, ডা. দীপু মনি, ব্যবসায়ী, সিনিয়র সচিবসহ একের পর এক রাঘববোয়ালকে গ্রেফতার করেছে ডিবি। দিনরাত লাগাতার চেষ্টা করে এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক গুরুত্বপূর্ণ আসামিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের এ ইউনিট। এছাড়া ডিবিকে গণমুখী করার জন্য নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) রেজাউল করিম মল্লিক যুগান্তরকে বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হওয়া হত্যা মামলার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসামিকে আমরা গ্রেফতার করেছি। এছাড়া ভিআইপি আসামিদের প্রায় শতভাগই আমরা গ্রেফতার করেছি।’

বিগত সরকারের আমলে ডিবি ছিল অনেক ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকের পাওনা টাকা তোলার হাতিয়ার। বর্তমানে এ বিষয়ে ডিবির অবস্থান কী জানতে চাইলে রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, ‘আমি ডিবির দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে এসব অপতৎপরতা বন্ধ করেছি। ডিবির কেউ এখন এসব (টাকা তোলা) কোনো প্রক্রিয়ার মধ্যেই নেই। ডিবিতে এমন সুপারিশ নিয়ে আসার সুযোগও নেই।’

চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবিপ্রধান বলেন, ‘চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের দ্রুত গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার কাজ অব্যাহত রয়েছে। এক্ষেত্রে ডিবির বিভিন্ন টিম নিরলসভাবে কাজ করছে।

সাইবার ক্রাইমের বিষয়ে দৃষ্টি অকর্ষণ করা হলে রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, ‘সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে চৌকশ টিম গঠন করা হয়েছে। তারা এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ডিবিতে সাধারণ মানুষ যেন সুবিচার পান, অন্যায় জুলুম থেকে বাঁচতে পারেন, সেটি নিশ্চিত করেছি আমি। এমনকি আমিও আইনের ঊর্ধ্বে না। কোনো কর্মকর্তা যদি আইন লঙ্ঘন করে, তারা যদি কোনো দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয় তবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’

নিজের কর্মজীবনে নানা বঞ্চনার কথা তুলে ধরে রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, আমি নির্যাতিত ও অবহেলিত এক পুলিশ কর্মকর্তা। চাকরিজীবনে প্রায় ১৮ বছর আমি কষ্ট সহ্য করেছি। যোগ্যতা থাকার পরও পুলিশের যত কম গুরুত্বপূর্ণ পদ আছে, সেখানে আমাকে পদায়ন করা হতো। ছুটি দেওয়া হতো না। এমনকি বাবা, মা ও বড় ভাইয়ের মৃত্যুর সময়ও তাদের দেখতে দেয়নি। দীর্ঘ ১৮ বছর এসব সহ্য করার পর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে হাজারো শহিদের রক্তের বিনিময়ে স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়েছে। এখন আমি ওই কষ্টগুলো ভুলে গিয়ে সরকার ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলার যে দায়িত্ব-কর্তব্য আছে, সেটি পালন করছি। এখন আমার একটাই টার্গেট। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখা। এ দেশের মানুষের জন্য কিছু করা।

জানা যায়, রাজধানীর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ডিএমপির ডিবি। কিন্তু বছরের পর বছর ডিবির বিরুদ্ধে ছিল নানা অভিযোগ। বিগত সময়ে রাজধানীর মিন্টু রোডের ডিবি অফিসের সামনে স্বজনের খোঁজে অনেকের পরিবার দিনের পর দিন অপেক্ষা করেছে। কেননা জোর করে তুলে আনার পর গ্রেফতার না দেখিয়ে দিনের পর দিন ডিবিতে আটকে রেখে নির্যাতন রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল। এছাড়া আসামিদের নির্যাতন করে টাকা আদায়, জমি দখলে সহযোগিতা, বিএনপি-জামায়াতসহ বিরুদ্ধ মতের অনেক নেতাকর্মীকে ধরে এনে নির্যাতনের ঘটনায় ডিবি এক আতঙ্কের নামে পরিণত হয়েছিল। বিভিন্ন সময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ নানা স্পর্শকাতর অভিযোগ উঠেছে ডিবির বিরুদ্ধে। ফলে বিগত সরকারের আমলে ডিবির কর্মকাণ্ড জনমনে চরম অসন্তোষ সৃষ্টি করে। ডিবির সাবেক প্রধান হারুন অর রশীদের ভাতের হোটেল নিয়ে সারা দেশেই মানুষ ক্ষুব্ধ ছিলেন। ফলে বর্তমানে ডিবির চ্যালেঞ্জ শুধু আসামি গ্রেফতার ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণই নয়; ডিবির ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করা।

ডিবির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ডিবিকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। বদলি করা হয়েছে সব কর্মকর্তাকে। ডিএমপির সাবেক ডিবিপ্রধান অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদের আমলে যেসব অনিয়ম ছিল, সেগুলো এখন আর নেই। কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে কাজের ধরন, পলিসি সব ক্ষেত্রেই পরিবর্তন আনা হয়েছে। জনবল সংকট থাকলেও ঢাকা মহানগরির ৮টি বিভাগ ও দুটি সাইবার ইউনিটে কাজ করছেন ডিবির কর্মকর্তারা। অনেক বিভাগে এখনো উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) পদমর্যাদার কর্মকর্তা নেই।

একইভাবে অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) ও সহকারী কমিশনার (এসি) পদমর্যাদার কর্মকর্তারাও প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেক। ইন্সপেক্টর থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত জনবল সংকট থাকার পরও গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে ক্রাইম ডেটা তৈরি, অপরাধীর তালিকা তৈরি, ভিআইপি আসামিদের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে ডিবি। ডিএমপির বিভিন্ন বিভাগে এলাকাভিত্তিক চোর, ডাকাত, খুনি, ছিনতাইকারীসহ অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের ওপর নজরদারিও করছে। অনেককেই ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ডিবি। প্রতিদিনই ভুক্তভোগীরা বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে সাইবার ক্রাইম বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে আসছেন।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম