Logo
Logo
×

শেষ পাতা

সাবেক এমপি মাহফুজুর রহমান মিতার দুর্নীতি

ব্যাংকে রক্ষিত সম্পদ-অর্থ অনুসন্ধানের নির্দেশ

নিজ ও পরিবারের নামে বিপুল পরিমাণ জ্ঞাতআয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ * জেটি নির্মাণে হাতিয়ে নিয়েছেন ১২৫ কোটি টাকা

Icon

মিজান চৌধুরী

প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ব্যাংকে রক্ষিত সম্পদ-অর্থ অনুসন্ধানের নির্দেশ

দেশি-বিদেশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে সাবেক এমপি মাহফুজুর রহমান মিতাসহ পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাব চাওয়া হয়েছে। যেসব হিসাব চাওয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-লেনদেনের বিবরণী, সঞ্চয়ী ও চলতি হিসাব, ডিপিএস, এফডিআর, স্বর্ণ ও লকার। এছাড়া তার বিরুদ্ধে বিআইডব্লিউটিএর জেটি নির্মাণ ঘিরে ১২৫ কোটি টাকা আত্মসাৎসহ সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ জ্ঞাতআয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সরকারি-বেসরকারি ও বিদেশি ৬৬টি ব্যাংকের কাছে এসব তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছে। এর আগে মাহফুজুর রহমানের দুর্নীতি অনুসন্ধানের জন্য তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দুদক। ওই কমিটির কাজের অংশ হিসাবে ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

চট্টগ্রাম-৩ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতা ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে তিনবার এমপি ছিলেন। দায়িত্ব পালনকালে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন তিনি। তবে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর চট্টগ্রামের কোথাও তাকে দেখা যায়নি। অনেকটা আত্মগোপনে চলে গেছেন।

বিভিন্ন ব্যাংকে পাঠানো দুদকের চিঠিতে বলা হয়, মাহফুজুর রহমান মিতার বিরুদ্ধে ক্ষমতা অপব্যবহার করে অপরিকল্পিতভাবে জেটি নির্মাণপূর্বক ১২৫ কোটি টাকাসহ ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। সে অর্থ দিয়ে নিজ ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যের নামে দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমাণ জ্ঞাতআয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন। সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে কোনো ব্যাংকে সঞ্চয়ী, চলতি, এফডিআর, ডিপিএস, স্বর্ণ, লকার, সঞ্চয়পত্র বা অন্য কোনো হিসাব থাকলে সেগুলোর হিসাব বিবরণী পর্যালোচনা করা একান্ত প্রয়োজন। চিঠিতে স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা উল্লেখ্য করে ব্যাংকগুলোর কাছে মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী, সন্তানসহ ছয়জনের তথ্য চাওয়া হয়। এরমধ্যে রয়েছে স্ত্রী মাহমুদা মুস্তাফিজ, সন্তান-মাহেম রহমান জিম, রাইমন মুস্তফা, তানজাবিল রহমান। এছাড়া মোহসেন আরা রহমান নামে এক ব্যক্তি রয়েছেন ওই তালিকায়। অভিযুক্তদের স্থায়ী ঠিকানা দেওয়া হয়েছে চটগ্রামের সন্দ্বীপ বাউরিয়া কুছিয়া মোড়া গ্রামের এমপি সাহেব বাড়ি এবং বর্তমান ঠিকানা ২৮/এ-৩ টয়েনবি সার্কুলার রোড সন্দ্বীপ ভবন মতিঝিল ঢাকা। বিভিন্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইওদের উদ্দেশে ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘উল্লিখিত ব্যক্তির নামে আপনার ব্যাংকের কোনো শাখায় কোনো হিসাব থাকলে উক্ত হিসাবের হিসাববিবরণী সরবরাহের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’

এদিকে দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটের প্রতিবেদনে মাহফুজুর রহমান মিতার দুর্নীতির প্রাথমিক প্রমাণ মিলেছে। সেখানে বলা হয়, ৩ মেয়াদে এমপি থাকাকালে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দাখিল করা হলফনামায় তার বার্ষিক আয় ছিল ৪৭ লাখ ৫ হাজার ৮০৫ টাকা। গত ১০ বছরে তার আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৪ লাখ ৬৭ হাজার ৮২৪ টাকা। যা ২০১৪ সালের বার্ষিক আয়ের তুলনায় ১০১.২ শতাংশ বেশি এবং অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ১৯৯.২৩ শতাংশের বেশি। স্ত্রী মাহমুদা মাহফুজের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ১৯০ শতাংশের বেশি। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে মিতা ও তার স্ত্রীর নামে পূর্বাচলে প্লট, মতিঝিলে ৫ কাঠা জমির ওপর নির্মিত বিল্ডিং, গুলশানে ফ্ল্যাট, উত্তরা দিয়াবাড়িতে ৫ কাঠা জমির প্লট, হারামিয়া সন্দ্বীপে জমি, বাড়ি এবং মাহফুজুর রহমান মানি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে কোটি কোটি টাকা পাচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

এর আগেও ২০২০ সালে মিতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অনুসন্ধানে নেমে সেখান থেকে সরে আসে দুদক। মিতার বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগটি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করে কমিশন। ২০২১ সালে অভিযোগ নিষ্পত্তির বিষয়টি অনুমোদন করার পর ২ মার্চ তৎকালীন দুদক সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার অব্যাহতির বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের কাছে চিঠি দিয়ে জানান। এরপর বিষয়টি মাহফুজুর রহমান মিতাকে চিঠি দিয়ে জানানোর পাশাপাশি মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সিনিয়র সচিবকে অনুলিপি দিয়ে জানানো হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালে ৯ মার্চ অবসরে যাওয়া দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের আগ্রহে তড়িঘড়ি করে মিতার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শেষ করা হয়।

সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে দ্বিতীয় দফায় এমপি হওয়ার পর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মাহফুজুর রহমান মিতা। ওই সময় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১৯৭ কোটি টাকার বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স আনোয়ার ল্যান্ডমার্ক, মেসার্স বিশ্বাস বিল্ডার্স ও মেসার্স ডলি কনস্ট্রাকশনের কাছ থেকে ১০ শতাংশ কমিশন আদায় করেন তিনি। শুধু তাই নয়, ঠিকাদাররা কাজ শুরু করলে সেখানে অনৈতিক হস্তক্ষেপ করে নিজের লোক দিয়ে নিুমানের নির্মাণসামগ্রী সরবরাহ করেন চট্টগ্রাম-৩ আসনের সাবেক এই এমপি। এছাড়া বিআইডব্লিউটিএর গুপ্তছড়া জেটি নির্মাণ দুর্নীতিতেও মাহফুজুর রহমান মিতার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া যায় সে সময়। সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাটে ৫২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা দিয়ে নতুন একটি জেটি নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছিল তৎকালীন সরকার। তা নির্মাণের কাজ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স এসএস রহমানকে দেওয়ার জন্য ডিও দিয়েছিলেন মিতা। এখানেও কমিশনের বিনিময়ে নিজস্ব ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া ২০১৮ সালের সন্দ্বীপের পিআইও অফিস থেকে টেন্ডার হওয়া ২৭টি ব্রিজের কাজ সাবেক এমপি মিতা তার নিজস্ব লোকজনের মধ্যে ১৫ শতাংশ টাকা কমিশনের বিনিময়ে ভাগবাঁটোয়ারা করেন বলে জানা যায়।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, টেন্ডার ও কমিশন বাণিজ্যের হাত থেকে রক্ষা পায়নি সন্দ্বীপের শিক্ষা খাতও। ২০২০ সালে দুদকে আসা অভিযোগে বলা হয়, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের কাজের টেন্ডারে কোনো ঠিকাদার মিতার অনুমতি ছাড়া অংশ নিতে পারেননি। নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন দেওয়ার বিনিময়ে এই অধিদপ্তরের সব টেন্ডারে এমপি মনোনীত একজন করে ঠিকাদার অংশ নেন। কমিশন নিয়ে কাজ পাইয়ে দেওয়ার ওয়াদা দিয়ে তা রক্ষা করেন মিতা। ফলে সেই কাজও পান তার আশীর্বাদপুষ্ট ঠিকাদার।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম