এক দিনে বছরের সর্বোচ্চ ১১ মৃত্যু
বৃষ্টি নেই তবু কমছে না ডেঙ্গুর প্রকোপ
নভেম্বরের ২৩ দিনে আক্রান্ত ২৪,৯৭৪ এবং মৃত্যু ১৪৪ জন * বহুমাত্রিক ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দিতে হবে -অধ্যাপক গোলাম ছারোয়ার
জাহিদ হাসান
প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার বংশবিস্তারের অনুকূল পরিবেশ বৃষ্টিপাত। এ কারণেই প্রতি বছর বর্ষাকালে রোগটির প্রকোপ বেশি দেখা দেয়। তবে প্রকৃতিতে এখন বৃষ্টি নেই। বরং ভোরের দিকে ঠান্ডা হাওয়া জানান দিচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা। নভেম্বর মাস বিদায় নেওয়ার পথে। এমন পরিস্থিতিতেও কমছে না ডেঙ্গুর প্রকোপ। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যু সংখ্যা। শনিবার সকাল ৮টা থেকে রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আরও ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা চলতি বছরে এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ সময়ে ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক হাজা ১৭৯ জন।
জনস্বাস্থ্যবিদরা জানান, সাম্প্রতিক বছরগুলোর পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার ঊর্ধ্বমুখী থাকে। নভেম্বরের দিকে সেটি কমে আসে। কারণ নভেম্বরে বৃষ্টিপাত খুব একটা হয় না। বৃষ্টির পানি জমে থাকার সম্ভাবনাও থাকে না। মশা কমলে ডেঙ্গু রোগী কমে যাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে এসেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বেড়ে চলছে। চলতি নভেম্বর ২৩ দিনে আক্রান্ত হয়েছেন ২৪ হাজার ৯৭৪ জন এবং মারা গেছেন ১৪৪ জন। এর আগের মাস সেপ্টেম্বরে আক্রান্ত হয় ১৮ হাজার ৯৭ জন, মৃত্যু হয় ৮৭ জনের। অক্টোবরে আক্রান্ত হয় ৩০ হাজার ৮৭৯ জন, মৃত্যু হয় ১৩৫ জনের।
রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগী বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৬ হাজার ৭৯১ জনে। আর মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৪৫৯ জনে। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে পাঁচজন, দক্ষিণ সিটিতে চারজন এবং খুলনা বিভাগে দুজন রয়েছেন।
এ সময় হাসপাতালে নতুন ভর্তি রোগীদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ৯৭ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১১৩ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ২৭২, ঢাকা উত্তর সিটিতে ১৯৪, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ১২১ ও খুলনা বিভাগে ১৪৩ জন রয়েছেন। এছাড়াও রাজশাহী বিভাগে ৫৮ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৩৫ জন, রংপুর বিভাগে ৫৮ জন এবং সিলেট বিভাগে ৯ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে ৬৩ দশমিক ২০ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৬ দশমিক ৮০ শতাংশ নারী। এ সময় মারা গেছে ৪৫৯ জন। এর মধ্যে নারী মৃত্যু ৫১ দশমিক ১০ শতাংশ। আর পুরুষ ৪৮ দশমিক ৯০ শতাংশ।
কীটতত্ত্ববিদরা যুগান্তরকে বলেন, বর্ষা মৌসুমের শেষ দিকে এসে যেখানেই বৃষ্টির পানি জমছে, সেখানেই এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে। আবার এমন কিছু জায়গায় এডিস মশা প্রজনন করছে, যেখানে বৃষ্টির পানির সম্পর্ক নেই। এর মধ্যে রয়েছে বহুতল ভবনের পার্কিংয়ের জায়গা, নির্মাণাধীন ভবনের বেজমেন্ট, ওয়াসার মিটার বাক্স এবং বাসাবাড়িতে জমিয়ে রাখা পানি। তাই প্রত্যেককে নিজ বাড়ির আঙিনা পরিষ্কার রাখা দরকার। কোনো পাত্রে যাতে পানি না জমে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কিন্তু এ বিষয়ে সাধারণ নাগরিক থেকে সিটি করপোরেশন কোনো পক্ষই তেমন পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)-এর কীটতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার বলেন, গতানুগতিক ধারায় নভেম্বরে এডিস মশার প্রজননের জন্য অতটা অনুকূল পরিবেশ থাকে না। এসময় ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড দেখিয়ে দিচ্ছে পরিবর্তিত পরিবেশের প্রভাব কতটা মারাত্মক ও ভয়াবহ। যথাযথ বৈজ্ঞানিক নীতিমালার অভাবে মশক নামক ছোট্ট কীটটি কতটা প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে সেটির বার্তা দিচ্ছে। মশার ভিতর বেড়ে ওঠা ডেঙ্গু ভাইরাস মশার পরিবর্তিত শরীরে কত স্বাচ্ছন্দ্যে মিউটেশন ঘটিয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে সেটাই জানান দিচ্ছে। ডেঙ্গু এখন আর সিজনাল রোগ নয়। এডিস মশাও শুষ্ক মৌসুমকে আর তেমন পাত্তা দিচ্ছে না। এ থেকে বাঁচতে এখনই মশা ও ভাইরাসের প্রতিরোধী মাত্রা নির্ণয় করে উপযোগী কীটনাশক ও বহুমাত্রিক ব্যবস্থাপনার সঠিক প্রয়োগে গুরুত্ব দিতে হবে।
নভেম্বরে এসে আক্রান্ত ও মৃত্যুহার বাড়ার জন্য ভারত-মিয়ানমারের ডেঙ্গুর ডেন-২ ভ্যারিয়েন্টকেও দায়ী করছেন চিকিৎসকরা। এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তদের মধ্যে যারা ক্রনিক ডিজিজ বা দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভুগছেন তাদের শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছে। এছাড়া দেরিতে হাসপাতালে আসাও মৃত্যুর অন্যতম কারণ বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের জুন মাস থেকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। গত বছর দেশে তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন। এর মধ্যে ঢাকায় এক লাখ ১০ হাজার ৮ এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন দুই লাখ ১১ হাজার ১৭১ জন। এর আগে ২০১৯ সালে দেশব্যাপী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন। ওই সময় চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীসহ প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে সারা দেশে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। ওই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এছাড়া ২০২২ সালে ডেঙ্গু নিয়ে মোট ৬২ হাজার ৩৮২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ওই বছর মশাবাহিত রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে ২৮১ জন মারা যান।