আমনের ভরা মৌসুম ও আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহার
চট্টগ্রামে তবুও কমছে না চালের দাম
বস্তায় বেড়েছে ৩০০ টাকা পর্যন্ত * মিলার ও করপোরেট হাউজের কারসাজি
আহমেদ মুসা, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আমনের ভরা মৌসুমেও চট্টগ্রামে বাড়ছে চালের দাম। দাম স্থিতিশীল রাখতে শুল্ক প্রত্যাহার, বিপুল পরিমাণ চাল আমদানির পরও বাজারে দামের প্রভাব নেই। প্রতি বস্তা চালের দাম ১৫ দিনের ব্যবধানে বেড়েছে ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, টাস্কফোর্স গঠন, আমদানির অনুমোদন দিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে ভোক্তাদের নাভিশ্বাস উঠেছে।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, মিল মালিকদের কারসাজিতে বাড়ছে চালের দাম। গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে দুই দফা বেড়ে বর্তমানে ৩ হাজার টাকার প্রতি বস্তা মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ২৫০ টাকা থেকে ৩ হাজার ৩০০ টাকা। উপজেলাগুলোতে খুচরা পর্যায় দাম আরও বেশি। উত্তরাঞ্চলের মিল মালিকরা পরিবহণ সংকট, সরবরাহ সংকট, ধানের দাম বৃদ্ধি ও মজুত কমে যাওয়া অজুহাত দেখিয়ে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। সিন্ডিকেট কারসাজি করে প্রতি বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে চালের বাজার অস্থির করে তোলেন মিল মালিকরা। এছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। মূলত প্রশাসনের নজরদারির অভাবকে পুঁজি করে ধান-চালের দাম ওঠানামা করান এসব আসাধু ব্যবসায়ী। অন্যদিকে নগরীর চাক্তাইর মিল মালিকরা বলছেন, গত দুই মাসে মনপ্রতি ধানের দাম বেড়েছে ২০০ টাকা পর্যন্ত। যার প্রভাব পড়েছে চালের বাজারে।
চালের আমদানি শুল্ক ১৫ শতাংশের পাশাপাশি রেগুলেটরি শুল্ক ৫ শতাংশ নির্ধারিত ছিল। গত ১ নভেম্বর সরকারি আদেশে এই শুল্ক প্রত্যাহর করা হয়। শুধু ২শতাংশ অগ্রিম আয়কর রাখা হয়।
এদিকে খাদ্য অধিদপ্তরের খোলাবাজারে (ওএমএস) এবং ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ডিলারদের মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষদের কম দামে চাল বিক্রি করছে। এরপরও চালের বাজার স্থিতিশীল থাকছে না। বেশির ভাগ মিলার চাল মজুত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। একইভাবে জি-টু-জি’র আওতায় বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি করা হলেও বাজারে চালের দামে প্রভাব পড়ছে না। চট্টগ্রামে বড় কোনো চাল কল নেই, যা আছে তার বেশির ভাগই ছোট। এসব কল চাল মজুত করে বাজারে প্রভাব ফেলার সক্ষমতা নেই। এখন চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে বড় করপোরেট হাউজগুলো। তারা চালকল মালিক বা মিলারদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ চাল কিনে নিচ্ছে। এরপর তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ডে মোড়ক দিয়ে বাজারজাত করছে। পাশাপাশি এসব চাল বাজারে অতিরিক্ত দামে বিক্রি করছে। একটি করপোরেট হাউজ একশটি বা তারও বেশি কলের সব চাল একসঙ্গে কিনে নিচ্ছে। দেশের চার-পাঁচটি করপোরেট হাউজ এভাবে সিংহভাগ কল থেকে চাল কিনে নেওয়ায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পড়ছেন বিপাকে। করপোরেট হাউজগুলোর সঙ্গে টিকতে পারছেন না তারা। সেই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে করপোরেট হাউজগুলো। তারা চালের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে। ফলে বাড়ছে চালের দাম। আবার অনেকে চাল আমদানির অনুমতি নিয়ে চাল আমদানি করছেন না। ফলে সরবরাহ কিছুটা কম।
নগরীর পাহাড়তলী-চাক্তাই চালপট্টি ঘুরে দেখা যায়, সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। চাক্তাই চালপট্টিতে পাইকারি বাজারে মোটা সিদ্ধ চালের দাম বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ৩০০ টাকা বেড়ে মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৯০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা। একইভাবে প্রতি বস্তায় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা বেড়ে মানভেদে মিনিকেট আতপ চাল বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৪০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা। দিনাজপুরী পাইজাম ৩ হাজার ৪০০ টাকা থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা; যা আগে ছিল ৩ হাজার টাকার কাছাকাছি। কাটারিভোগ চাল বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৬০০ টাকার বেশি দামে।
স্বর্ণা সিদ্ধ চাল প্রতি বস্তা ৩ হাজার ১০০ থেকে ৩ হাজার ১০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে; যা আগে ছিল ২ হাজার ৮০০ টাকা। নাজিরশাইল সিদ্ধ ৩ হাজার ২০০ টাকা থেকে ৪ হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে; যা আগে ছিল ৩ হাজার ৮০০ টাকা থেকে ৩ হাজার ৯০০ টাকা। পাইজাম সিদ্ধ ৩ হাজার ৭০০ টাকা থেকে ৩ হাজার ৮৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে; যা আগে ছিল ৩ হাজার ৬০০ টাকা। চিনিগুঁড়া চাল ৫৮০০ টাকার বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
খুচরা বাজারে জাত ও মানভেদে চিকন চাল নাজিরশাইল চাল ৮০ থেকে ৮২ টাকা, মিনিকেট চাল ৬৮ থেকে ৭৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর মাঝারি মানের বিআর ২৮ ও ২৯ নম্বর চাল ৬৭ থেকে ৭০ টাকা এবং গুটি, স্বর্ণা, চায়না ইরিসহ মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৮ টাকা, যা আগে কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত কম ছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে খাদ্য বিভাগের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না। শুল্ক কমানোর পর এর সুবিধা একটি পক্ষ নিয়ে নিচ্ছে, ভোক্তারা পাচ্ছেন না। সরকারের নজরদারিতে ঘাটতি রয়েছে, তদারকি আরও বাড়াতে হবে। সরকার এখন শুধু খুচরা পর্যায়ে তদারকি করছে। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য উৎপাদক, করপোরেট, মিল, পাইকারি ও খুচরা সব স্তরেই তদারকি করতে হবে, যা হচ্ছে না।
চাক্তাই চালের আড়তদার সাইফুল ইসলাম জানান, চালের দাম বাড়ান মিলাররা। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন মোকাম থেকে চাল সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন তারা। গত ১৫ দিনে মোটা চিকন সব ধরনের চালে কেজিতে চার টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। চাল আমদানি হয়েছে শুনেছি; কিন্তু বাজারে এখনো আসেনি। মনে হয় না তেমন কোনো লাভ হবে।