রেলের ইঞ্জিন-কোচ কেনায় অনীহা
অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক লুটপাট
১৫ বছরে ইঞ্জিন ও কোচ ক্রয়ে ব্যয় ৩৫০০ কোটি টাকা * রেলপথ নির্মাণসহ অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় এক লাখ ১১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা
আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে রেলের অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ, মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধিসহ নানাভাবে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে অধিকাংশ প্রকল্পে। অথচ অতি জরুরি ইঞ্জিন-কোচ কেনায় গত ১৫ বছর অনীহা দেখিয়েছেন সংস্থাটির দুর্নীতিবাজরা।
দফায় দফায় সময় ও ব্যয় বাড়িয়ে ইঞ্জিন ও কোচ কেনার সুযোগ না থাকায় এক যুগের বেশি সময়ে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ১০১টি ইঞ্জিন ও ৩০০ কোচ কেনা হয়েছে। অথচ প্রয়োজন ছিল ৭০০ ইঞ্জিন ও ৩০০০ হাজার কোচের। অপরদিকে এ সময়ে এক লাখ ১১ হাজার পাঁচশ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে রেলপথসহ অবকাঠামো নির্মাণে। সময়োপযোগী রোলিংস্টক না থাকায় শুধু রেলপথের অবকাঠামো নির্মাণে রেলের আয় ও গতি বাড়েনি। দৃশ্যমান হয়নি উন্নয়ন।
শুক্রবার সন্ধ্যায় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল বাকী যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছরে রেলে যে পরিমাণ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে-এর মূলেই ছিল অনিয়ম, দুর্নীতি আর লুটপাট। আবার নতুন রেলপথসহ অবকাঠামো নির্মাণ ঘিরে সংশ্লিষ্টরা দুর্র্নীতিতে ব্যস্ত থাকায় ইঞ্জিন-কোচ ক্রয় করা হয়নি।
তিনি বলেন, ইঞ্জিন-কোচ ক্রয়ে সময় ও ব্যয় বাড়ানো যায় না। রেলপথ নির্মাণসহ অন্য প্রকল্পে সময়-ব্যয় বাড়িয়ে ১০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। উন্নয়ন ঘিরে যে লুটপাট হয়েছে, এর সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। উন্নয়ন ঘিরে দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত পেয়ে দুদক কাজ করছে। গত সপ্তাহে আমাদের কাছেও তথ্য-উপাত্ত ও নথিপত্র চেয়েছে। আমরা দুদকে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, দেড় যুগ আগে দেশে ট্রেনের সংখ্যা ছিল ৩৯৭টি-বর্তমানে ৩২৫টি। এখনও বন্ধ রয়েছে ৭২টি ট্রেন। অর্থাৎ গত ১৫ বছরে ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধি নয়, কমেছে। এমন অবস্থায় ২০০৯ সালে রেল লোকসান গুনেছে ৬২৫ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লোকসান দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকায়। অবকাঠামো উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় গত ১৫ বছরে ইঞ্জিন-কোচের প্রয়োজন যা ছিল সে তুলনায় মাত্র ১০ শতাংশ ক্রয় করা হয়েছে। বর্তমানে ৩০৩টি ইঞ্জিন ও ১৯০২টি কোচ রয়েছে।
এসবের মধ্যে ৭৭ শতাংশ ইঞ্জিন এবং ৮৪ শতাংশ কোচের আয়ুষ্কাল শেষ। এসবের অধিকাংশই চলন্ত অবস্থায় ‘ফেইলিউর’ হচ্ছে। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সময় ও নিয়ম মেনে ট্রেন চলছে না। শিডিউল বিপর্যয় ঘটছে। এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের ইঞ্জিন-কোচ ক্রয়েও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এসংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে দুদকে বেশ কয়েকটি মামলার অনুসন্ধান চলছে। তবে অবকাঠোসংক্রান্ত প্রকল্পের চেয়ে ইঞ্জিন-কোচ ক্রয় প্রকল্পের দুর্নীতি তুলনামূলক কম।
রেলওয়ে অপারেশন ও পরিকল্পনা দপ্তর সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে ৩২৫টি ট্রেনের মধ্যে পূর্বাঞ্চলে ১৫৪টি এবং পশ্চিমাঞ্চলে ১৭১টি ট্রেন চলছে। এর মধ্যে ১১২টি আন্তঃনগর ট্রেন রয়েছে। প্রতিটি ট্রেনের গড়ে ৮ থেকে ১২টি কোচ স্বল্পতা নিয়ে চলাচল করছে।
ক্ষোভ উগরে পরিকল্পনা দপ্তরের এক কর্মকর্র্তা বলেন, ‘শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছরে ১৪২টি ট্রেন উদ্বোধন করেছে। নতুন কোচ এবং বন্ধ করে দেওয়া ট্রেনের কোচ সমন্বয়ে একের পর এক ট্রেন উদ্বোধন করা হয়েছে। কম কোচ নিয়ে চলা ট্রেনে নতুন কোচ যুক্ত হয়নি। স্বল্প কোচ নিয়ে চলা ট্রেনগুলোতে পর্যাপ্ত (২৪টি করে) কোচ যুক্ত হতো তবে এতে টিকিট বিক্রিতে প্রায় দ্বিগুণ লাভ হতো।
একই ইঞ্জিন, চালক ও গার্ড দ্বারা আয় বাড়ানো যেত। অথচ আওয়ামী লীগ সরকার ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী’ উপলক্ষ্যে ৫৩টি রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম-ছাউনি লম্বা করণে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। নামেমাত্র প্ল্যাটফর্ম ও ছাউনি লম্বা করা হলেও-চলমান কোনো ট্রেনেই নির্ধারিত কোচ যুক্ত করা হয়নি। অভিযোগ উঠেছে, নতুন রেললাইন নির্মাণসহ অবকাঠামো উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। প্রকল্প শুরুতে যে অর্থ বরাদ্দ হয়েছে-তা পরবর্তী সময়ে ব্যয় বাড়িয়ে ১০ গুণেরও বেশি করা হয়।
পরিবহণ দপ্তর সূত্র বলছে, নতুন রেলপথ ও অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে প্রায় ৭০০ ইঞ্জিন ও ৩০০০ কোচ প্রয়োজন ছিল। ওই পরিমাণ কোচ ও ইঞ্জিন ক্রয় করা হলে আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া ৭৭ শতাংশ ইঞ্জিন, ৮৪ শতাংশ কোচ পরিবর্তন করে বর্তমানের চেয়ে দিগুণের বেশি (প্রায় ৭০০) ট্রেন পরিচালনা করা সম্ভব হতো। নতুন রেলপথ ঢাকা-কক্সবাজার ও ঢাকা-যশোর রুটে ১০০ ট্রেন চালানো যেত। এ দুটি রুটে বর্তমানে মাত্র ৫টি ট্রেন চলাচল করছে। অথচ এ দুই রুট নির্মাণে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। এসব লুটপাটের উন্নয়ন লোকসান বাড়াবে।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল বাকী আরও বলেন, উন্নয়নের সুফল পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। আগামী ২ বছর সামনে রেলে একটি ছক তৈরি করা হয়েছে। ইঞ্জিন-কোচের অভাবে ট্রেন পরিচালনা যেমন করা যাচ্ছে না-তেমনি আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া রোলিংস্টকগুলো পরিবর্তন করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে ইঞ্জিন-কোচ ও রোলিংস্টক ক্রয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে রেলপথ নির্মাণ ও অবকাঠামো উন্নয়নে সম্পৃক্তদের আমলনামা প্রস্তুত করা হচ্ছে। রেল সাধারণ মানুষের নিরাপদ ও সাশ্রয়ী বাহন। এ বাহনকে সাধারণ মানুষের সেবা ও নিরাপত্তায় নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করছি।
রেলের পাহাড়তলী, সৈয়দপুর কারখানা, পার্বতীপুর, ঢাকাসহ বিভিন্ন ডিজেল কারখানায় যথাযথ বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়া হয়নি চলমান রেলপথ সংস্কার ও রোলিংস্টক সরঞ্জাম ক্রয়ে। ফলে কারখানাগুলোতে দক্ষ শ্রমিক-কর্মচারী থাকলেও কাঙ্ক্ষিত অনুযায়ী ইঞ্জিন, কোচ মেরামত ও কোচ তৈরি সম্ভব হয়নি। বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও কারখানাগুলোতে দেশীয় প্রযুক্তিতে কোচ নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি বরাদ্দের অভাবে।
দ্বিগুণ আয় সম্ভব : এখনও ৭২টি ট্রেন এবং ১২৪টি স্টেশন বন্ধ রয়েছে। গত ১৫ বছরে এসব বন্ধ স্টেশন ও ট্রেন চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অথচ ওই সময়ে মধ্যে আরও অন্তত ১৩৩টি নতুন স্টেশন নির্মাণ করে আওয়ামী লীগ সরকার। ওই সব স্টেশনের অধিকাংশই বন্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। কোনো কোনো স্টেশন অর্ধশত কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করা হলেও কোনো কাজে আসছে না।
অপরদিকে চলমান ৩২৫টি ট্রেন স্বল্প কোচ নিয়ে চলাচল করছে। স্বল্প কোচ দিয়ে এসব ট্রেন পরিচালনা করে বছরে ৭০০ কোটি টাকা আয় করছে। প্রতিটি ট্রেন পর্যাপ্ত (৮ থেকে ১২টি) কোচ লাগিয়ে পরিচালনা করা হলে আয় হতো প্রায় দ্বিগুণ। বর্তমানে ট্রেন পরিচালনায় প্রত্যেক যাত্রীর পেছনে কিলোমিটারপ্রতি প্রায় আড়াই টাকা খরচ হয়। আয় এর অর্ধেকের মতো।
সামছুল হক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও পরিবহণ বিশেষজ্ঞ ড. এম সামছুল হক যুগান্তরকে বলেন, খুবই অবাক করা বিষয় ট্রেন ও স্টেশন বন্ধ বছরের পর বছর। অথচ লুটপাটের নেশায় অপরিকল্পিতভাবে নতুন রেলপথ ও অবকাঠামো নির্মাণে এগিয়ে ছিল বিগত সরকার।
অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প ঘিরে ব্যয় ও সময় বাড়িয়ে কোটি কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। সরকার, রেলপথমন্ত্রী, সচিবরাসহ সংশ্লিষ্টরা লুটপাটের প্রকল্পে নজর ছিল। ইঞ্জিন-কোচ ক্রয়ে এক প্রকার অনীহা ছিল। রেলে ২০১০ সাল থেকে বিপুল বিনিয়োগ শুরু হয়।
কিন্তু ট্রেনের গতি বাড়েনি, বাড়েনি আয়। নিশ্চিত হয়নি নিরাপত্তা। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হওয়ার পরও কি করে ইঞ্জিন-কোচের সংকট হয়। উন্নয়ন ঘিরে লুটপাটের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং অপরিকল্পিত প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করা, এখন সময়ের দাবি বলে তিনি জানান।