বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন
পোশাক রপ্তানিতে নিট আয় ৫৮ শতাংশ
রপ্তানি আয়ের তথ্য সংশোধনের কারণে গত দুই অর্থবছর ধরে পোশাক খাতের আয় কমছে * ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানোর ফলে নিট আয় ছিল ৭১ শতাংশ, তথ্য সংশোধন করায় তা ৬০ শতাংশে নেমে এসেছে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
তৈরি পোশাক রপ্তানিতে গত ৩ অর্থবছর ধরে দেশের নিট বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে গড়ে ৫৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ। বাকি ৪২ দশমিক ৪৬ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রাই চলে যাচ্ছে এ শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করতে। গত কয়েক বছর ধরে এ খাতের কাঁচামাল আমদানি কমছে। এর প্রভাবে রপ্তানিও কমছে। ফলে নিট রপ্তানি আয়ও কমে গেছে।
তবে দেশে গার্মেন্ট খাতের পশ্চাৎ সংযোগ শিল্পের প্রসার হওয়ায় শতকরা হিসাবে নিট রপ্তানি আয় বাড়ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রপ্তানি আয়ের তথ্য আগে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হতো। যে হার রপ্তানি বাড়ার তথ্য দেখানো হতো সে হারে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসত না। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার হিসাবেও জটিলতার সৃষ্টি হয়। পরে রপ্তানি আয়ের তথ্য সংশোধনের পর গার্মেন্ট খাতের নিট আয় আরও কমে যায়। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে জুন-এই ৬ মাসে তৈরি পোশাক খাতের নিট আয় ৭১ শতাংশের বেশি দেখানো হয়েছিল। রপ্তানি আয় সংশোধনের ফলে এ খাতের নিট আয় ৫৪ শতাংশে নেমে আসে।
এছাড়াও পোশাক খাতে অনেক বিদেশি কর্মকর্তা কর্মরত। তাদের বেতন-ভাতা দিতে হচ্ছে বিদেশি মুদ্রায়। কাঁচামাল আমদানির বিপরীতে ডলারে দায় শোধ করা হলেও পণ্য দেশে আসছে না। ওইসব অর্থ বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। এর বাইরে রপ্তানিকারকরা রিটেনশন কোটার আওতায় বিদেশে ডলার রেখে খরচ করতে পারেন। ওইসব অর্থের একটি অংশ ব্যবসায়িক কাজে খরচ না করে তা দিয়ে বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তুলছেন। ওইসব অর্থও পাচার হিসাবে গণ্য হচ্ছে। এসব অর্থ বাদ দিলে নিট রপ্তানি আয় আরও কম হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে তৈরি পোশাক খাত থেকে মোট রপ্তানি আয় হয়েছিল ৪ হাজার ২৬১ কোটি ডলার। এর বিপরীতে কাঁচামাল আমদানি বাবদ খরচ হয়েছিল ১ হাজার ৯৪৪ কোটি ডলার। ওই বছরে নিট আয় হয়েছিল ২ হাজার ৩১৭ কোটি ডলার বা ৫৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আগে পোশাক খাত থেকে রপ্তানি আয় দেখানো হয়েছিল ৪ হাজার ৬৯৯ কোটি ডলার। পরে তা সংশোধন করে দেখানো হয় ৩ হাজার ৮১৭ কোটি ডলার।
ওই বছরে কাঁচামাল আমদানিতে খরচ হয়েছে ১ হাজার ৫৯৯ কোটি ডলার। ফলে প্রকৃত হিসাবে নিট আয় হয়েছে ২ হাজার ২১৮ কোটি ডলার। আগের হিসাবে নিট আয় ছিল ৩ হাজার ১০০ কোটি ডলার। ফলে নিট হিসাবে রপ্তানি আয় হয়েছে ৫৮ দশমিক ১১ শতাংশ। আগের হিসাবে নিট আয় হয়েছিল ৬৬ শতাংশ।
সূত্র জানায়, রপ্তানি আয় ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানোর ফলে সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত দেখাচ্ছিল। এতে বাজারে ডলারের প্রবাহ বাড়ার কথা থাকলেও বাস্তবে বাজারে ডলারের সংকট ছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে রপ্তানি আয়ের তথ্য সংশোধন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে যেসব ডলার দেশে এসেছে তাকেই প্রকৃত রপ্তানি আয় ধরে হিসাব করা হয়। ফলে রপ্তানি আয় কমে গেছে। একই সঙ্গে সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবও উদ্বৃত্ত থেকে ঘাটতিতে চলে গেছে। এর সঙ্গে অন্যান্য হিসাবেও ঘাটতি বেড়ে যায়। ওই সময়ে এ খাতে ৮৮২ কোটি ডলার রপ্তানি আয় বেশি দেখানো হয়েছিল।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে পোশাক খাতে মোট রপ্তানি আয় হয়েছে ৩ হাজার ৬১৩ কোটি ডলার। ওই বছরে কাঁচামাল আমদানি করা হয়েছে ১ হাজার ৪৪০ কোটি ডলার। এ হিসাবে নিট আয় হয়েছে ২ হাজার ১৭৩ কোটি ডলার বা ৬০ দশমিক ১৪ শতাংশ। ওই অর্থবছরের শুরুর দিকেও রপ্তানি আয় ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছিল। পরে তা সংশোধন করা হয়।
২০২৩ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিট রপ্তানি আয় ৫১ থেকে ৫৭ শতাংশের মধ্যে ছিল। ওই বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর থেকে নিট রপ্তানি আয় বাড়তে থাকে। ওই সময় থেকে গত অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত রপ্তানি আয় বাড়িয়ে দেখানোর কারণে নিট আয় ৭১ থেকে ৭২ শতাংশে বেড়ে যায়। রপ্তানি আয় কমানোর ফলে এ খাতে নিট আয়ও কমে আসে ৬০ শতাংশে। বিদেশিদের বেতন-ভাতা ও পাচার করা অর্থ বাদ দিলে নিট আরও কম হবে।
গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে রপ্তানি দেখানো হয়েছিল ১ হাজার ১৬২ কোটি ডলার। পরে তা সংশোধন করে দেখানো হয় ৮৮২ কোটি ডলার। অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে দেখানো হয় ১ হাজার ১৭৭ কোটি ডলার। পরে তা সংশোধন করে দেখানো হয় ৮৭৪ কোটি ডলার। জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে আয় দেখানো হয় ১ হাজার ৩৮১ কোটি ডলার। পরে তা সংশোধ করে দেখানো হয় ৯৭৩ কোটি ডলার।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, রপ্তানি আয়ের তথ্য সংশোধনের কারণে গত দুই অর্থবছর ধরে পোশাক খাতের আয় কমছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি আয় কমেছে ৪৪৪ কোটি ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানি আয় কমেছে ২০৪ কোটি ডলার। ওই সময়ে কাঁচামাল আমদানি যেমন কমেছে, তেমনি নিট রপ্তানি আয়ও কমেছে।
২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে নিট রপ্তানি আয় কমেছে ৯৯ কোটি ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নিট রপ্তানি আয় কমেছে ৪৫ কোটি ডলার।