রেলের বগি সংস্কার প্রকল্পে করুণ চিত্র
আড়াই বছরে ১০০ বগির একটিও পুনর্বাসন হয়নি
বাংলাদেশ রেলওয়ের বগি সংস্কার প্রকল্পে বেহাল অবস্থা বিরাজ করছে। এ বিষয়ে প্রকল্প গ্রহণ করেও সময়মতো শেষ করতে পারছে না। শুধু সময় আর অর্থ বাড়িয়ে দেশের ক্ষতি ডেকে আনা হয়। এরকম একটি প্রকল্পের নাম ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের জন্য ৫০টি বিজি এবং ৫০টি এমজি যাত্রীবাহী ক্যারেজ পুনর্বাসন।’ এখানে মোট ১০০টি যাত্রীবাহী বগি সংস্কার করার কথা। কিন্তু প্রকল্প গ্রহণ করার পর সময় চলে গেছে প্রায় আড়াই বছর। কিন্তু সংস্কারে ব্যয় হয়েছে সামান্যই। যার আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ১৯ শতাংশ। পাশাপাশি ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৭ শতাংশ। এর ফলে কার্যত একটি বগিও পুনর্বাসন হয়নি।
অথচ প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৩৮৪ কোটি ৪৬ লাখ ৯১ হাজার টাকা। ২০২২ সালের জুন থেকে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়। এখন সময় বাড়ানো হলে ব্যয় বাড়বে। এ আশঙ্কার বিষয়টি সত্য হয়ে দেখা দেয় সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির (পিএসসি) সভায়। ৩ অক্টোবর রেল ভবনের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত এ সংক্রান্ত সভায় সভাপতির বক্তৃতা করেন রেল সচিব আবদুল বাকীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রকল্পের বিভিন্ন অসঙ্গতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, রেলের প্রকল্পের কমন সমস্যা হলো প্রকল্প তৈরিতে নানা ত্রুটি, প্রয়োজনীয় বরাদ্দের অভাব এবং কার্যকর মনিটরিংয়ের অভাবে বাস্তবায়নের গতি শ্লথ হয়ে আসা। এ প্রকল্পেটিও এমন সব চিত্র ফুটে উঠেছে।
সাবেক পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশিদ বুধবার যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পের এমন অবস্থার জন্য দায়ী হলো প্রকল্পটি তৈরি থেকে বাস্তবায়ন পর্যায়ে যারা যুক্ত ছিলেন তারাই। অর্থাৎ রেলপথ মন্ত্রণালয়। একটি প্রকল্প আড়াই বছরে শূন্য দশমিক ১৯ শতাংশ অর্থ খরচ করবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। কেননা বাস্তবায়ন যত দেরি হবে প্রকল্প ব্যয় ততই বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। এরকম প্রকল্প চলমান রাখার চেয়ে কাটছাঁট করে ফেলা উচিত।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুল বাকী পিএসসি সভায় সিদ্ধান্তের বিষয়ে বলেন, বাংলাদেশ রেলওয়ের বিদ্যমান অপারেটিং সিস্টেমকে আপডেট করে ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেমের কাজটি উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে করতে হবে। ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য সাধারণ বৈদ্যুতিক বাতি সংযোজনের পরিবর্তে এলইডি লাইট ব্যবহারের বিষয়ে যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হবে। এছাড়া প্রকল্পের যেসব আইটেমে ব্যয় কমানো সম্ভব তা যাচাই করে নিশ্চিত করতে হবে।
পিএসসি সভায় প্রকল্প পরিচালককে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ঈদের আগে অর্থাৎ মার্চের মধ্যে ২০টি কোচ পুনর্বাসন করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশ রেলওয়ের বিদ্যমান অপরেটিং সিস্টেমকে আপডেট করে ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেমের কাজটি বিআরএএসএসের মাধ্যমে চালুর জন্য ডাইরেক্টর ইনভেন্টরি কন্ট্রোল ও বিআরএএসএস প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পৃথক মডিউল প্রণয়ন করতে হবে বলে ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। তবে সিংগেল সোর্স সিলেকশনের মাধ্য বিআরএএসএস প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠানকে নিয়োজিত করা হলে সার্ভার, আইপিএস ও অন্যান্য খরচ কম হতে পারে।
সভায় পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) প্রতিনিধি বলেন, ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেমে কিউআর কোড রাখা হচ্ছে কিনা, নাকি কম্পিউটারে মালামালগুলো ইনপুটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে তা জানা প্রয়োজন। কার্যক্রম বিভাগের প্রতিনিধি বিদ্যমান মনিটরিং সিস্টেম থাকা সত্ত্বেও ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম থাকা প্রয়োজন আছে কিনা, সে বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য বলেন।
বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) পার্থ সরকার ওই সভায় বলেন, পরিকল্পনা কমিশন এই বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য নির্দেশনা দেন। সভায় বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী জানতে চান যে, ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেমটি না রাখলে প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো সমস্যা হবে কিনা। উত্তরে প্রকল্প পরিচালক জানান, এ খাতে ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) ৩০ লাখ টাকার সংস্থান রয়েছে। এ খাতটি বাদ দিলে প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো সমস্যা হবে না।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) সভায় বলেন, ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেমটি সিঙ্গেল সোর্সেস সিলেকশনের মাধ্যমে করার বিষয়টি ডিপিপিতে উল্লেখ নেই। এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন প্রয়োজন হবে।
রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী বলেন, সিঙ্গেল সোর্স সিলেকশনের মাধ্যমে ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম করতে গেলে এখানে আইনগত জটিলতা, টেন্ডার ভেরিয়েশনসহ বিভিন্ন পর্যায়ে কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। রেলপথের যুগ্ম সচিব (পরিকল্পনা) বলেন, ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেমটি উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে করা উচিত হবে।
সভায় প্রকল্প পরিচালক বলেন, ডিপিপিতে ৬৬ কেভিএ ক্ষমতাসম্পন্ন ২৮টি ডিজেল জেনারেটর ক্রয়ের সংস্থান রয়েছে। বর্তমানে জেনারেটর প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো ৬৬ কেভিএ ক্ষমতাসম্পন্ন ডিজেল জেনারেটর তৈরি করে না। এ বিষয়ে জিইডির প্রতিনিধি বলেন, ৬৬ কেভিএ ক্ষমতাসম্পন্ন ডিজেল জেনারেটর এবং ৬০ কেভিএ ক্ষমতাসম্পন্ন ডিজেল জেনারেটরের মধ্যে কারিগরি কোনো পার্থক্য আছে কিনা সেটি দেখা দরকার। এছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়ে স্পেসিফিকেশন অনুমোদনের বিষয়ে কোনো সমস্যা আছে কিনা তা টেকনিক্যাল রিপোর্টের মাধ্যমে যাচাই করতে পারে।
রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) বলেন, বাংলাদেশ রেলওয়ের বর্তমানে যে আন্তঃনগর ট্রেনগুলো চলাচল করছে তা ৩৬৫ কিলোওয়াটের উপরে। এগুলো অবসোলেট হয়ে গেছে। ডিপিপিতে ৬৬ কেভিএ ক্ষমতাসম্পন্ন ডিজেল জেনারেটর ক্রয়ের সংস্থান রাখা উচিত হয়নি। ৬০ থেকে ৭০ কেভিএ ক্ষমতাসম্পন্ন ডিজেল জেনারেটর কেনার সংস্থান ডিপিপিতে রাখা হলে ঠিক হতো। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ডিপিপিতে সাধারণ বৈদ্যুতিক বাতি সংযোজনের সংস্থান রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে কোচে অত্যাধুনিক এলইডি লাইট ব্যবহার করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রশাসনিক অনুমোদন প্রয়োজন। এতে ব্যয় সাশ্রয় হবে।
প্রকল্প পরিচালক আরও বলেন, প্রকল্পের পুনর্বাসনের কাজের জন্য প্রয়োজনীয় মালামাল সংগ্রহে ২৫টি প্যাকেজের টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ। ১৭টি লটে সরবরাহকারীর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে। ৮টি লটের পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। প্রকল্পের কোচ পুনর্বাসনের মাস ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ বছরে ৪০টি কোচ পুনর্বাসনের জন্য নির্ধারিত আছে। চলতি বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে মালামাল পাওয়া গেছে।