চট্টগ্রামে তৎপর বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা
সভা-সমাবেশে সরব মাথায় নির্বাচন
শহীদুল্লাহ শাহরিয়ার, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন-তারিখ এখনো ঠিক হয়নি। নির্বাচন পদ্ধতিতে সংস্কার আসবে কি না, জোট নাকি দলীয়ভাবে দল নির্বাচনে অংশ নেবে-ঠিক হয়নি সেটিও। কিন্তু নির্বাচন যে আসন্ন-সেটি নিশ্চিত ধরে নিয়ে এটি ছাড়া অন্যকিছু ভাবছেন না চট্টগ্রাম বিএনপির নেতারা। দলীয় কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি এলাকায় সাধারণ মানুষের কাছে উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন তারা। বিশেষ করে আসন্ন সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হতে আগ্রহীরা এলাকায় সভা-সমাবেশ ও শোডাউন করছেন। এলাকায় নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। কয়েকদিনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে বিষয়টি উঠে এসেছে। চট্টগ্রাম উত্তর, দক্ষিণ ও নগর বিএনপির নেতারাও যুগান্তরের কাছে অভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন।
চট্টগ্রামে উত্তরের ৬টি, দক্ষিণের ৬টি এবং নগরীর ৪টি মিলে ১৬টি সংসদীয় আসন। সব এলাকায়ই তৎপর দেখা যাচ্ছে বিএনপি নেতাদের। প্রাথমিকভাবে রাষ্ট্র সংস্কারের যে ৩১ দফা বিএনপি দিয়েছে, সেগুলো মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন লিফলেট বিতরণ, সভা-সমাবেশ ও অন্যান্য কর্মসূচির মাধ্যমে। ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষ্যে সভা-সমাবেশ করেছে দলটি। রোববার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর উপস্থিতিতে নগরীর জমিয়তুল ফালাহ এলাকায় বিপ্লব ও সংহতি দিবসের বিশাল সমাবেশে উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা থেকে বিএনপি নেতারা হাজারো মানুষের মিছিল নিয়ে আসেন। দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা-কর্ণফুলী উপজেলা থেকে বড় মিছিল নিয়ে আসেন দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব আলী আব্বাস।
কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের পরও নিজ এলাকা হাটহাজারীতে চষে বেড়াচ্ছেন ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন। সোমবার দিনভর হাটহাজারীতে দলীয় কর্মসূচিতে ব্যস্ত সময় পার করেন দলের এ ‘তরুণতুর্কি’। প্রায় ৫০ হাজার কর্মী-সমর্থক নিয়ে করেছেন বিপ্লব ও সংহতি দিবসের মিছিল। এদিন লোহাগাড়া উপজেলায় শোডাউন করেছেন আবু জাহেদ নামে উপজেলা বিএনপির এক নেতা।
চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, বিএনপি নির্বাচনমুখী দল। বর্তমানেও দলীয় কর্মসূচি পালনের পাশপাশি আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। বর্তমান সরকারের প্রধান কাজ নির্বাচন কমিশন এবং কিছু অর্থনৈতিক সংস্কার। তাছাড়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেড় বছর আগে ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। তাতে সমর্থন দিয়েছে ৪২টি রাজনৈতিক দল। আগামী নির্বাচনে যদি বিএনপি ক্ষমতায় আসে, সবাইকে নিয়ে রাষ্ট্র সংস্কার করবে। সরকারকে নির্বাচন দিতে চাপ প্রয়োগ করাসহ দলীয় কর্মসূচি ঠিক করতে শুক্রবার নগর বিএনপির ৫৩ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে বৈঠক করব।
মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যতই সংস্কারের কথা বলুক না কেন, তাদের প্রধান কাজ হওয়া উচিত একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যতটুকু সংস্কার দরকার সেটুকু করা। নির্বাচন দিয়ে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। কারণ, জনগণের মনের ভাষা এবং দুঃখ-দুর্দশা বোঝার ক্ষমতা রয়েছে নির্বাচিত সরকারের। গণতন্ত্রের বিকল্প হিসাবে শেখ হাসিনা উন্নয়নের ধোয়া তুলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন। কিন্তু দেশের জনগণ আন্দোলনের মাধ্যমে তাকে বিতাড়িত করেছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নির্মম পতনের বিষয়টি সব ক্ষমতাসীনদের জন্যই একটি শিক্ষা। তাই আমি আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করবে। কারণ তাদের সামনে আর কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচিত সরকারই সব ধরনের সংস্কারের দায়িত্ব নেবে।
হাটহাজারীতে যোগাযোগ বাড়িয়ে দেওয়া প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার মীর হেলাল বলেন, ‘আমার রাজনীতির আঁতুরঘর হাটাহাজারী। আমি যদি আমার ঘরে রাজনীতির সুফল পৌঁছাতে না পারি, জনগণের সমর্থন আদায় করতে না পারি তবে সেক্ষেত্রে সফলতা আসবে না।’
চট্টগ্রাম নগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন আদালতের নির্দেশে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার সবকিছু সংস্কার করতে পারবে না। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টানা যায়নি। তিন মাসে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি। তাই দেরি না করে সরকারের উচিত নির্বাচন আয়োজন করা। দেশের জনগণই ঠিক করবে আগামী দিনে কারা দেশ চালাবে। গণতন্ত্রের উত্তরণ ও জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠায় নির্বাচনই একমাত্র নিয়ামক।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক এনামুল হক এনাম পটিয়ায়, সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আলী আব্বাস আনোয়ারা-কর্ণফুলী নির্বাচনি এলাকায় কাজ করছেন। ২০১৮ সালে পটিয়া থেকে বিএনপির টিকিটে সংসদ-সদস্য পদে নির্বাচন করেন এনামুল হক এনাম। অন্যদিকে আনোয়ারা-কর্ণফুলী থেকে মনোনয়ন চাইলেও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গ্রেফতার হয়ে সাড়ে চার বছরেরও বেশি সময় কারান্তরিন ছিলেন। এ কারণে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। তবে আগামী নির্বাচনে পটিয়া থেকে এনামুল হক এনাম এবং আনোয়ারা-কর্ণফুলী থেকে আলী আব্বাস দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। এ লক্ষ্যে এখন থেকেই তারা এলাকায় কাজ শুরু করে দিয়েছেন।
পটিয়ায় দীর্ঘ ১৫-১৬ বছর রাজপথে থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের রোষানলে ছিলেন এনামুল হক এনাম। দফায় দফায় গ্রেফতার-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তবে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর পটিয়ার বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলমের গাড়িকাণ্ডে জড়িয়ে দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদকের পদ থেকে বহিষ্কার হন। পদ চলে গেলেও পটিয়া নির্বাচনি এলাকায় প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো সভা-সমাবেশে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে অংশ নিচ্ছেন। বিপ্লব ও সংহতি দিবসের আলোচনা সভার পাশাপাশি বিএনপির ৩১ দফা নিয়ে মানুষের ঘরে ঘরে যাচ্ছেন এনাম। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ভালো কাজ করলে পুরস্কৃত এবং খারাপ কাজ করলে তিরস্কৃত হতে হবে, এটাই স্বাভাবিক। তার বিশ্বাস, ত্যাগী নেতা হিসাবে দল অবশ্যই তাকে মূল্যায়ন করবে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর মানুষ কথা বলার স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে। রাতে আতঙ্কহীনভাবে ঘুমাতে পারছে বিএনপি নেতাকর্মীরা, এটাই প্রাথমিক বিজয়। তবে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে নির্বাচিত সরকারের বিকল্প নেই।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম সম্পাদক আলী আব্বাস যুগান্তরকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষ একটাই প্রত্যাশা করছে-সেটা হচ্ছে নির্বাচন। ভোটের যে অধিকার আওয়ামী লীগ কেড়ে নিয়েছিল, তারা সেই অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন। ছাত্র-জনতা প্রাণ দিয়েছে। তাই নির্বাচন বিলম্বিত হলে ছাত্র-জনতার রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা হবে। দেশে সংকট দীর্ঘস্থায়ী হবে। আমার এলাকার সাধারণ মানুষও নির্বাচনি ডামাডোলের অপেক্ষার প্রহর গুনছেন।