Logo
Logo
×

শেষ পাতা

বেতাগী কৃষি কর্মকর্তার লাগামহীন দুর্নীতি

অস্তিত্বহীন প্রকল্প-প্রদর্শনী ও কৃষকের স্বাক্ষর জালিয়াতি

বিভিন্ন খাত থেকে লুট ৭ কোটি টাকা * ওয়েবসাইট থেকে তথ্য গায়েব

Icon

শফিকুল ইসলাম ইরান, বেতাগী (বরগুনা)

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অস্তিত্বহীন প্রকল্প-প্রদর্শনী ও কৃষকের স্বাক্ষর জালিয়াতি

বরগুনার বেতাগী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তানজিলা আহমেদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির মাধ্যমে প্রায় ৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। গেল দুই অর্থবছরে দুই ডজনের বেশি অস্তিত্বহীন প্রকল্প ও অর্ধশতাধিক প্রদর্শনী, কৃষকের স্বাক্ষর জালিয়াতিসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে এই অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এই কৃষি কর্মকর্তা।

জানা গেছে, ২০২৩-২৪ ও ২৪-২৫ অর্থবছরে পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা জোরদারকরণ, আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে উন্নত মানের ধান, পাট ও বীজ উৎপাদন সংরক্ষণ ও বিতরণ, তেল জাতীয় ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প, সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে খামার যান্ত্রিকীকরণসহ ২৮টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে রাজস্ব খাত থেকে ১ কোটি ৫৪ লাখ ৭১ হাজার ৩২৫ টাকা বিভিন্ন চেকের মাধ্যমে উত্তোলন করা হয়। কিন্তু কোনো প্রকল্পই বাস্তবায়ন করা হয়নি।

এছাড়া একই জমিতে একাধিকবার বিভিন্ন প্রদর্শনীর শুধু সাইনবোর্ড ঝুলিয়েই বরাদ্দের পুরো টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। ‘রবি, আউশ ও আমনের প্রদর্শনী’, ‘পতিত জমি ও বাড়ির আঙিনায় সবজি ও পুষ্টি বাগান’ এবং ‘কন্দাল ফসল ও ফলজ বাগান’-উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে এ রকম অর্ধশতাধিক প্রদর্শনীর কার্যক্রম কাগজে-কলমে শেষ করা হয়েছে। কিন্তু কৃষকরা এসব প্রদর্শনীর সাইনবোর্ড ছাড়া কিছুই দেখেননি। এসব প্রদর্শনীর ১ কোটি ২৩ লাখ টাকাও হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এভাবে দুই অর্থবছরে প্রকল্প ও প্রদর্শনী খাতে মোট ২ কোটি ৭৭ লাখ ৭১ হাজার টাকা লুট হয়েছে।

এদিকে কৃষকদের প্রশিক্ষণের নামেও ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। প্রশিক্ষক না দিয়েই কৃষকদের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে উত্তোলন করা হয়েছে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ভাতার অর্থ। এই খাতে কৃষকপ্রতি বিভিন্ন প্রশিক্ষণে প্রায় ৩ হাজার ৯০০ টাকা বরাদ্দ থাকে। উপজেলায় তালিকাভুক্ত প্রান্তিক কৃষকের সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি। যদিও সবাই এসব প্রশিক্ষণ পান না। তবে যতগুলো প্রশিক্ষণ কেবল কাগজে-কলমে অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে প্রায় ১০ হাজারের বেশি কৃষক রয়েছেন। সে হিসাবে ৩ কোটি টাকার ওপরে দুর্নীতি হয়েছে। এছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রণোদনার আওতায় সহায়তাপ্রাপ্ত কৃষকের তালিকায় রয়েছেন ৫ হাজার ২০৫ জন। বলা হয়েছে, তারা সবাই ১ হাজার টাকা করে সহায়তা পেয়েছেন, আনুষঙ্গিকসহ ওই প্রণোদনায় টাকার পরিমাণ অর্ধকোটির বেশি (৫২ লাখ ৯৫ হাজার ৭০০)। কিন্তু কৃষকরা বলছেন, এসব বরাদ্দের বিষয়ে তারা কিছুই জানেন না। তাদের স্বাক্ষর জাল করে মাস্টাররোল তৈরি করে ভুয়া প্রশিক্ষণ ও কৃষি উপকরণ বিতরণের নামে এসব অর্থ লোপাট করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ ও সহায়তাপ্রাপ্তদের তালিকায় নাম থাকা কৃষক আয়নাল সিকদার, আলতাফ হাওলাদার, জব্বার সিকদার, তৈয়ব আলী জানান, তারা নিরক্ষর, কোনোদিন কলম ধরেননি। কোথাও স্বাক্ষর থাকলে সেটি টিপসই হতে পারে, কিন্তু স্বাক্ষর কীভাবে এলো তা তারা জানেন না।

হোসনাবাদ ইউনিয়নের প্রান্তিক কৃষক মহসিন হাওলাদার বলেন, আমার নামও নাকি তালিকায় আছে। আমি ৩ একর জমি চাষাবাদ করি। আজ পর্যন্ত কোনোদিন প্রশিক্ষণের জন্য কৃষি অফিস ডাকেনি। কৃষি যন্ত্রপাতি, বীজ বা আর্থিক সুবিধা দূরে থাক কোনোদিন এক কেজি সারও পাইনি।

কৃষক বাবু হাওলাদারের নামও রয়েছে ওই তালিকায়। তিনি বলেন, এত বছর ধরে কৃষিকাজ করি কিন্তু একটি লেবুগাছ ছাড়া কোনোদিন কিছু পাইনি।

বুড়ামজুমদার ইউনিয়নের বাসিন্দা আ. রহিম, জাকির হোসেন ও শামসুল হক একই রকম তথ্য দিয়ে বলেন, কৃষি অফিসের মাড়াই মেশিন মাসুদ নামের এক ব্যক্তি ক্রয় করেছেন বশির নামের এক সার ব্যবসায়ীর কাছ থেকে। কীভাবে ক্রয় করেছেন আমরা তা কিছুই জানি না। শুনেছি কৃষি অফিসার সব কাগজপত্র দিয়েই বিক্রির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

কৃষি যান্ত্রিকীকরণের নামেও চুরি : ২০২০-২১ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য বিতরণ করা হয় ২টি কম্বাইন হারবেস্টর মেশিন, ২১টি পাওয়ার থ্রেসার, ১৯টি সিডার। বেতাগী উপজেলায় বরাদ্দ দেওয়া মোট ৪২টি যন্ত্রে সরকারের ভর্তুকি ও কৃষকদের অর্থ মিলিয়ে মোট ৭৮ লাখ ৩২ হাজার ৮৫৭ টাকার আধুনিক কৃষিযন্ত্র ক্রয় করা হয়। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ অর্থ সরকারের ভর্তুকি বাবদ, বাকি ৩০ শতাংশ কৃষকদের। তবে কৃষকদের মাঠে এসব যন্ত্রের কোনো হদিস নেই। এসব মেশিন একটি মাস্টারমাইন্ড সিন্ডিকেটের মাধ্যমে উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে নামধারী কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হলেও কিছুদিন পরে কৃষি কর্মকর্তার যোগসাজশে কারসাজি করে ওই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছেই পুনরায় বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।

এদিকে জাতীয় তথ্য বাতায়ন ওয়েবসাইটে ‘বেতাগী উপজেলা কৃষি অফিস’-এর বিগত ৩ বছরের এসব অনিয়ম সংক্রান্ত সব তথ্য গায়েব হয়ে গেছে। আপলোড করা বিভিন্ন বরাদ্দ সংক্রান্ত পিডিএফ ফাইল ও নোটিশসহ উন্মুক্ত সব তথ্য মুছে ফেলা হয়েছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বেতাগী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তানজিলা আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, তালিকাভুক্ত কৃষক ছাড়া আমরা কাউকে কৃষি উপকরণ কিংবা সার, বীজ দিই না। তাও কাজ করতে গেলে একটু এদিক-ওদিক হয়েই থাকে। ভুয়া প্রকল্প, অস্তিত্বহীন প্রদর্শনী, মাস্টাররোল ও কৃষকের জাল স্বাক্ষরের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সব অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেন। ওয়েবসাইটের তথ্য গায়েবের বিষয়ে তিনি বলেন, এসব আমার দায়িত্ব নয়। এ সময় তিনি প্রতিবেদককে সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য আর্থিক সুবিধার প্রস্তাব দেন। প্রতিবেদক এতে রাজি না হলে সংবাদ প্রকাশ করলে মামলার হুমকি দেন এই কৃষি কর্মকর্তা।

বেতাগী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারুক আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, কৃষি অফিসসংক্রান্ত বেশ কিছু অভিযোগ শুনেছি, কিছুদিন আগে একটি ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় ভ্রাম্যমাণ আদালতে সম্পৃক্তদের লক্ষাধিক টাকা জরিমানা করেছি। কিছু কৃষি যন্ত্রপাতি বিক্রির অভিযোগ ও কিছু মালামালের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসবের তদন্ত চলছে। তিনি বলেন, সব অভিযোগের বিষয়ে বিধি মোতাবেক তদন্ত কমিটি গঠন করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অবগতির জন্য পাঠানো হবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম