বান্দরবানে ৫৬ উন্নয়ন প্রকল্প
ঠিকাদার-প্রকৌশলী মিলে শতকোটি টাকা লোপাট
মুহাম্মদ আবুল কাশেম
প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানে ৫৬টি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ না করেই ২৭৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। অধিকাংশ প্রকল্পই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। বাস্তবে কোনো কাজ হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের বান্দরবান ইউনিট অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বিন মোহাম্মদ ইয়াছির আরফাত এই অনিয়ম ও দুর্নীতির হোতা। তিনি এবং সাবেক এমপি বীর বাহাদুর উশৈসিং ও ঠিকাদার অমল কান্তি দাশ মিলে সিন্ডিকেট তৈরি করে উন্নয়ন বরাদ্দের অর্থ লুটে নেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নির্বাহী প্রকৌশল আবু বিন মোহাম্মদ ইয়াছির আরাফাত পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন সহায়তার আওতায় বান্দরবানের ৭ উপজেলার জন্য নামে-বেনামে অন্তত ৫৬টি প্রকল্প অনুমোদন নেন। যার মধ্যে ২৮টি প্রকল্পে কোনো কাজ না করে ১২৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকা পকেটে ভরেছে সিন্ডিকেট। যেসব প্রকল্পের টাকা সিন্ডিকেটের সদস্যরা মিলেমিশে পকেটস্থ করেছেন সেগুলো হলো- বান্দরবান সদর উপজেলার কিবুকছড়া থেকে উদালবনিয়া উপর পাড়া রাস্তা ও রাজবিলা-রমতিয়া হয়ে বাঙ্গালহালিয়া পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণে ৫ কোটি টাকা। থানচি উপজেলায় ১ নম্বর রেমাক্রী ইউনিয়নের দলিয়ানপাড়া থেকে নাফাকুম ঝর্ণা হয়ে রেমাক্রী পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণে ১২ কোটি টাকা। নাইক্ষংছড়ি উপজেলার স্টেডিয়ামের গ্যালারির অসমাপ্ত কাজ সমাপ্তকরণ দেখিয়ে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। রোয়াংছড়ি উপজেলার বান্দরবান জেলা পরিষদ স্কুল অ্যান্ড কলেজের হোস্টেল ভবন নির্মাণ দেখিয়ে ২ কোটি টাকা। লামা উপজেলার মুরুং হোস্টেল ভবন নির্মাণ দেখিয়ে ১ কোটি টাকা। বান্দরবান সদর উপজেলার এমডিএস হাসপাতাল ভবনের ব্লক ৩ ও ৪ নির্মাণের নাম দিয়ে ৪ কোটি টাকা। বান্দরবান সদরে জেলা বাস টার্মিনালের উন্নয়ন দেখিয়ে ৬ কোটি টাকা। বান্দরবান হিলটপ রেস্ট হাউজের ভবন নির্মাণের নামে ৮ কোটি টাকা। এ রকম আরও ২০টি প্রকল্পের কাজ শুধু কাগজে-কলমে ঠিক রাখা হয়েছে; কিন্তু বাস্তবে কোনো কাজ না করে প্রকল্পের অর্থ নিজেদের পকেটে ভরেছেন প্রকৌশলী ও ঠিকাদাররা।
অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, রোয়াংছড়ি উপজেলায় প্রকল্পের কাজ শেষ না করেই ৮টি প্রকল্পের ৫১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন প্রকৌশলী ইয়াছির আরাফাত ও ঠিকাদাররা। এর মধ্যে ২০১১-২০২২ অর্থবছরে রোয়াংছড়ি উপজেলা সদর হতে কাইন্তারমুখ পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ কোটি ২৯ লাখ টাকা; যার মধ্যে ৭৫ শতাংশ কাজ করা হয়। ২০১৪-২০২২ অর্থবছরে খামতংপাড়া হতে পাইক্ষ্যংপাড়া হয়ে রুমা রোনিনপাড়া পর্যন্ত ১০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা, যেখানে কাজ হয়েছে ৬৬ শতাংশ। ২০১৫-২০২৩ অর্থবছরে বান্দরবান-রুমা সড়ক হতে কুমিপাড়া থেকে মংঞোপাড়া পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার সড়কে ৭ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়, কাজ হয়েছে মাত্র ৪৫ শতাংশ। ২০১৭-২০২২ অর্থবছরে নোয়াতংপাড়া থেকে ম্রখ্যংপাড়া পর্যন্ত ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪ কিলোমিটার রাস্তার ৪৫ শতাংশ কাজ করে বাকি কাজ করা হয় নেই। ২০১৯-২০২৩ অর্থবছরে বান্দরবান পার্বত্য জেলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক নির্মিত বিভিন্ন রাস্তা সংস্কারকরণে ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ২ দশমিক ৫০ কিলোমিটার রাস্তার কাজ হয়েছে ৮১ শতাংশ। ২০২০-২৪ অর্থবছরে ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে কচ্ছপতলীপাড়া থেকে চিনিপাড়া হয়ে দেবাতাখুমপাড়া হয়ে লক্ষীচন্দ্রপাড়া পর্যন্ত রাস্তা ও ব্রিজ নির্মাণ (১১ কিলোমিটার রাস্তা) প্রকল্পে মাত্র ৫ শতাংশ কাজ করে বাকি টাকা লোপাট করা হয়। ২০২০-২৩ অর্থবছরে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে আলেক্ষ্যংপাড়া পর্যন্ত ১ কিলোমিটার রাস্তার কাজ মাত্র ১৮ শতাংশ করে বাকি কাজের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। ২০২১-২৪ অর্থবছরে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নোয়াপতংমুখপাড়া সংলগ্ন নোয়াতংপাড়া খালের ওপর ৮০ মিটার সংযোগ সড়কসহ আরসিসি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ প্রকল্পের কোনো কাজ না করে সব টাকা প্রকৌশলীর পকেটে গেছে। এছাড়াও লামা উপজেলায় আরও ৩টি প্রকল্পের কোনো কাজ না করে ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা লুটপাট হয়; যার মধ্যে ২০২১-২৪ অর্থবছরে ১ নম্বর গজালিয়া ইউনিয়নের ফাদু খালের ব্রিজসহ ৮০ মিটার রাস্তা নির্মাণে ৭ কোটি টাকা। একই অর্থবছরে ৩নং ফাঁসিয়াখালি ইউনিয়নের কুমারী নীচপাড়া জামে মসজিদ থেকে চাককাটাপাড়ায় আলী আকবর বাড়ি হয়ে দোয়াশীয়া গ্রামে ২.২০ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০২১-২৩ অর্থবছরে লামা বাস টার্মিনালের ৪০০০ বর্গমিটার মাঠ উন্নয়নের নামে ১ কোটি টাকা। অন্যদিকে একই উপজেলায় আরও ৬টি প্রকল্পে ব্যাপক লুটপাট হয়; যার মধ্যে ২০১১-২২ অর্থবছরে চিউবতলী থেকে গুরুর বাজার পর্যন্ত ১০ কোটি টাকা ব্যয়ের কাজে ৭৯ শতাংশ করে বাকি কাজ করা হয়নি। ২০১১-২২ অর্থবছরে রুপসীপাড়া সড়ক হতে ম্যারাখোলা হয়ে ছোট বুম পর্যন্ত ৭ কোটি ২০ লাখ টাকার কাজের ৯৫ শতাংশ হয়েছে। ২০১৮-২২ অর্থবছরে ফাইতং হেডম্যানপাড়া থেকে রোয়াজাপাড়া হয়ে কারিয়াংপাড়া পর্যন্ত ৩ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পে কাজ করা হয়েছে ৬৯ শতাংশ। ২০২০-২৩ অর্থবছরে আজিজনগর ইউনিয়ন ইসলামিয়া মিশন থেকে (মুসলিমপাড়া হয়ে) চৌধুরী হর্টিকালচারাল এস্টেট পর্যন্ত ৪ কোটি টাকা ব্যয়ের ৫ কিলোমিটার রাস্তার কাজের ১১ শতাংশ করে বাকি টাকা লুটপাট হয়েছে। ২০২০-২৩ কুমারী-লামা-আলীকদম সড়ক হতে বিছন্যার ছড়া গ্রাম পর্যন্ত ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩ কিলোমিটার ব্রিক সলিংকরণে কাজ হয়েছে মাত্র ২৫ শতাংশ। ২০১৮-২২ অর্থবছরে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের রেস্ট হাউজ-কাম-অফিসে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ভবন নির্মাণে ৮৮ শতাংশ কাজ করেছেন ঠিকাদার। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ৮ প্রকল্পে চলেছে ব্যাপক লুটপাট। যার মধ্যে চাকঢালা থেকে মেহেরপুর পর্যন্ত ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩ কিমি. এইচবিবিকরণে ৯৩ শতাংশ কাজ করেছে ঠিকাদার। ২০১৭-২২ অর্থবছরে আশারতলী হতে প্রধানঝিড়ি হয়ে জামছড়ি পর্যন্ত ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পে ৭৬ শতাংশ কাজ করে বাকি টাকা নির্বাহী প্রকৌশলী ও ঠিকাদার পকেটে ভরেছেন। ২০১৮-২২ অর্থবছরে চাক হেডম্যানপাড়া থেকে (পিএইচপি) রাবার বাগান হয়ে লংগদু পর্যন্ত ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ কিমি. রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পে কাজ হয়েছে ২৫ শতাংশ। একই অর্থবছরে সদর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের হামিদায়পাড়া থেকে নিকুছড়ি যাওয়ার ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪ কিমি. রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পে কাজ হয়েছে ৭৯ শতাংশ। ২০২০-২৪ অর্থবছরে মোরুং বেলথলি থেকে লধুরমুখ পর্যন্ত ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পে কাজ হয়েছে মাত্র ২ শতাংশ। ২০২১-২৪ অর্থবছরে ৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে চাকঢালা থেকে নতুন চাকপাড়া পর্যন্ত ২ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করেছে ১ শতাংশ। একই অর্থবছরে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে স্টেডিয়ামের গ্যালারির কাজের মধ্যে হয়েছে মাত্র ১ শতাংশ।
ওই অর্থবছরেই ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস টার্মিনালের ২৫৩ বর্গমিটার ভবন নির্মাণ প্রকল্পে কাজ হয়েছে ১ শতাংশ। অপরদিকে কাজ না করে রুমায় ১৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের সব টাকা লুটপাট হয়েছে। ২০২১-২৫ অর্থবছরে ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে রুমা বগালেক সড়কের কমলাবাজার থেকে চিংলকপাড়া পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার রাস্তা ও ব্রিজ নির্মাণ প্রকল্পের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি। রুমা উপজেলার ৬ প্রকল্পে প্রায় ১৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা কাজ না করে ঠিকাদার অমল কান্তি দাস পকেটে ভরেছেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে এ প্রতিবেদক পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের বান্দরবান ইউনিট অফিসে যান। কিন্তু খবর পেয়েই ১৯ অক্টোবর ও ৩ নভেম্বর প্রকৌশলী অফিস ত্যাগ করে চলে যান। পরে প্রকৌশলীর মোবাইল ফোনে এসএমএস করে দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি কোনো জবাব দেননি।