কাপাসিয়ায় চলছে দখল রাজত্ব!
আমরাইদ ‘গরুর হাটের’ ইজারার টাকা হরিলুট * চরসম্মানিয়ায় কৃষকের মাটি বিক্রির পাঁয়তারা * ডায়মন্ড হ্যাচারির মুরগির লিটার অপসারণে লেদা কমিটি
শাহ সামসুল হক রিপন, গাজীপুর
প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সরকারি ইজারার মেয়াদের ৫ মাস বাকি থাকতেই গাজীপুরের কাপাসিয়ায় ৭ কোটি টাকার ‘আমরাইদ গরুর হাট’ জোরপূর্বক দখল করে দলীয় সিদ্ধান্তের কথা বলে ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে স্থানীয় বিএনপির কয়েকজন নেতাকর্মী। শুধু তাই নয়, আমরাইদ বাজারে ওই ইজারাদারের দুই কোটি টাকা মূল্যের একটি বাড়িও দখল করে নিয়েছে তারা। এছাড়া একই উপজেলার চরসম্মানিয়াসহ আশপাশের কৃষকদের খাল খননের মাটি নিলামে নেওয়ার জন্য স্থানীয় যুবদলের দুটি গ্রুপ পাঁয়তারা করছে বলে অভিযোগ কৃষকদের। একইভাবে টোক ইউনিয়ন এলাকার ‘ডায়মন্ড হ্যাচারির’ মুরগির পরিত্যক্ত বর্জ্য (লিটার) অপসারণের জন্য আওয়ামী লীগকে হটিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা একটি লেদা কমিটি গঠন করেছে।
আমরাইদ গরুর হাটের ইজারাদার মো. মজিবুর রহমান মোল্লা জানান, তিনিসহ স্থানীয় কিছু ব্যবসায়ী গত ১ বৈশাখ টেন্ডারের মাধ্যমে ৭ কোটি টাকায় এক বছরের জন্য ইজারা নিয়ে ইতোমধ্যে ৫ কোটি টাকা পরিশোধ করে দিয়েছেন। ৫ মাসের ওপর সময় থাকতে গত ১৩ আগস্ট রায়েদ ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ডা. মতিউর রহমান জাফর, সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বাদল, কৃষক দলের সভাপতি আব্দুস সহিদ ও তার ছেলে ছাত্রদলের সভাপতি জাহিদসহ বিএনপির নেতাকর্মীরা ওই বাজারে হানা দিয়ে ১৪ থেকে ১৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। পরের সপ্তাহের টাকাও তাদের বাধ্যতামূলক দিতে হবে বলে চাপ সৃষ্টি করলে ইজারাদারের লোকজন নিজেরাই ইজারা উঠিয়ে ১১ লাখ টাকা তাদের হাতে বুঝিয়ে দেন। এখানেই শেষ হয়নি রায়েদ ইউনিয়ন কৃষক দলের সভাপতি সহিদ ও তার ছেলে ছাত্রদলের সভাপতি জাহিদ ওই ইজারাদারের (মজিবুর রহমান মোল্লার) আমরাইদ বাজারে নির্মিত প্রায় দুই কোটি টাকা মূল্যের একটি বাড়ি ভাড়াটিয়াদের বের করে দখল করে নেয়। রায়েদ ইউনিয়ন কৃষক দলের সভাপতি আব্দুস সহিদ যুগান্তরকে জানান, গত ১৩ আগস্টের আমরাইদ বাজারের ঘটনাটি ছিল দলীয় সিদ্ধান্তে। আমার নেতা বলেছে (রিয়াজ ভাই) টাকা উঠাতে তাই আমি কাউন্টারে বসেছি। টাকা উঠিয়ে ওই টাকা আমি ইউনিয়ন বিএনপির সেক্রেটারি বাদল ভাইয়ের হাতে বুঝিয়ে দিয়েছি। আর বাড়ি দখলের বিষয়টি আমার পারিবারিক। আমিও জমি কিনেছি, মজিবরও জমি কিনেছে, কিন্তু দাগ ভুল করে আমার জমিতে বাড়ি করেছে। সে কত কোটি টাকা খরচ করে বাড়ি করেছে সেটি আমার দেখার বিষয় নয়। জমি আমার, বাড়িও আমার। রায়েদ ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বাদলের ফোন বন্ধ থাকায় বারবার চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে সভাপতি ডা. জাফর যুগান্তরকে জানান, ওইদিন তিনি বাজারে ছিলেন না, অসুস্থতার কারণে গাজীপুরে চলে গিয়েছিলেন।
কাপাসিয়ার চরসম্মানিয়া এলাকার কৃষক মামুনসহ স্থানীয় কৃষকরা জানান, ২০২১ সালে ওই এলাকার ব্রহ্মপুত্র নদ খননের পর কিছু মাটি তাদের জমিতে ফেলা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগে কাপাসিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা লুৎফর রহমান চেয়েছিলেন ওই মাটি নিলামে দিতে। কিন্তু স্থানীয় কৃষকরা তাতে বাধা দেয়। তখন সাবেক এমপি সিমিন হোসেন রিমি সরেজমিন গিয়ে কৃষকের কথা শোনেন। পরে তিনি কৃষকের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জমিতে স্তূপ করে রাখা ওই মাটি সমানভাবে খেতে ছড়িয়ে দিয়ে সবজি চাষের পক্ষে মত দেন এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুৎফর রহমানও রিমির মতামতের বিরোধিতা করেননি। কিন্তু গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর সনমানিয়া ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক নজরুল, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মোমেন ব্যাপারী, আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আবুল বাশার, ৯নং ওয়ার্ড যুবদলের সাধারণ সম্পাদক রিপন মাহমুদসহ বিএনপি নামধারী কিছু ব্যক্তি ওই মাটি নামমাত্র টাকায় নিলাম হাতিয়ে নেওয়ার চক্রান্ত করছে। ইতোমধ্যে চক্রটি ওই নিলাম পাইয়ে দেওয়ার জন্য নেতাকে (রিয়াজুল হান্নান) টাকা দিতে হবে বলে আমার কাছে টাকা চায়। তারা স্থানীয় তালাশ, মাহফুজ সরকার, কাউসার, সোহাগ ভূঁইয়া, কানন, মোকাম মাহমুদসহ অনেকের কাছ থেকেই দু-তিন লাখ টাকা করে তুলে নেতাকে দিয়েছেন। এখন কৃষকের খেতের মাটি কৃষককে ধরতে দিচ্ছে না চক্রটি।
যুবদলের নজরুলসহ অন্যরা পুলিশ নিয়ে রাতে কৃষকের বাড়িতে হানা দেয় এবং মাটি খেতে ছড়াতে বাধা দিচ্ছে। কিন্তু কৃষকের দাবি, জমি যার মাটি তার, জমির মালিক আমরা-মাটির মালিকও আমরা, হান্নান শাহর পুতে এই মাটি নিলামে দেওয়ার কে? মাটি রক্ষায় কৃষকরা নদীর পারে মানববন্ধন করে এ দাবি জানান। কৃষকরা আরও জানান, আমরা শুনেছি শিপনের নেতৃত্বে বাশার, রিপন এক গ্রুপ নিলাম পাওয়ার জন্য শাহ রিয়াজুল হান্নানকে ১২ লাখ টাকা দিয়েছে। অন্যদিকে যুবদলের সভাপতি নজরুলের নেতৃত্বে এক গ্রুপ আরও ১০ লাখ টাকা দিয়েছে। টাকার বিনিময়ে হান্নান শাহর ছেলে কৃষকের খেতের মাটি নিলামে উঠিয়ে যুবদলের ছেলেদের পাইয়ে দেবে এটি এলাকার আমপাবলিক সবাই জানে।
অভিযোগের বিষয়ে ৯নং ওয়ার্ড যুবদলের সাধারণ সম্পাদক রিপন মাহমুদ বলেন, কৃষকের মাটি কৃষকেরই থাকবে-এ মাটি নিলামে পাওয়ার জন্য আমরা কাউকে কোনো টাকা-পয়সা দিই নাই। উল্লেখিত বিষয়ে কাপাসিয়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শাহ রিয়াজুল হান্নান বলেন, আমি যেটি জানি চরসম্মানিয়ায় নদী খননের পর পরিত্যক্ত বালু ইজারা দেওয়ার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইজারা দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। এর বেশি কিছু আমার জানা নেই।
নবনির্বাচিত টোক ইউনিয়ন লেদা কমিটি : কাপাসিয়ার টোক ইউনিয়নে ২নং ওয়ার্ড কেন্দাবর গ্রামে অবস্থিত দেশের বৃহৎ ‘ডায়মন্ড হ্যাচারি’। এখানে আনুমানিক ১০-১২ লাখ মুরগি রয়েছে। ওই মুরগির পরিত্যক্ত বর্জ্য (লিটার) হয় প্রতিদিন আনুমানিক ১২-১৩ হাজার ব্যাগ। এত পরিমাণ বর্জ্য জমিয়ে রাখার সুযোগ নেই। শুরুতে আশপাশে কৃষকের ফসলি জমিতে ওই বর্জ্য ছড়িয়ে গেলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে কৃষকরা হ্যাচারির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। পরিস্থিতি সামলাতে কৃষকরা সাবেক এমপি সিমিন হোসেন রিমির কাছে গেলে তিনি কৃষকের কথা চিন্তা না করে হ্যাচারির পক্ষ নেন। কথিত আছে, তিনি প্রতি মাসে ৫ লাখ টাকা নগদ বুঝে পেয়েই খুশি থাকতেন এবং আওয়ামী লীগের ১০ জনের একটি সিন্ডিকেট গঠন করে ওই মুরগির লেদা (লিটার) অপসারণের নিয়ন্ত্রণ করতেন। কিন্তু ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগকে হটিয়ে স্থানীয় বিএনপির নেতৃত্বে ৬৪ জনের একটি লেদা কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং ওই লেদা অপসারণ বাবদ বিএনপি নেতা শাহ রিয়াজুল হান্নান নেন ১৫ দিনে ৫ লাখ টাকা।
ওই লেদা কমিটির সমন্বয়ক তাজউদ্দিন যুগান্তরকে জানান, আমি ছোট মানুষ কোম্পানির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে অনেক হয়রানির শিকার হয়েছি। এখন আর হয়রানি হতে চাই না। আমাকে লেদা কমিটির সমন্বয়ক বানানো হয়েছে। গেটে বস্তাপ্রতি ৭ টাকা করে জমা দিয়ে লেয়ার মুরগির লেদা (বর্জ্য, লিটার) বের করি এবং পার্টির কাছে বিক্রি করি ১৪ থেকে ১৫ টাকা। এর থেকে বেশি কিছু বলতে পারব না।
টোক ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. শামসুল হক রুকন বলেন, ডায়মন্ড হ্যাচারির মুরগির লেদা (লিটার) অপসারণ বাবদ কোম্পানিকে কোনো টাকা দিতে হয় না। কোম্পানি এটি ফ্রি হিসাবে দিয়ে থাকে। তবে শর্ত হচ্ছে সিজন-অফসিজন অর্থাৎ সারা বছরই এই লেদা (লিটার) অপসারণ করতে হবে। গেট পাশ হিসাবে ৭ টাকা হারে প্রতি মাসে যে ২৫-৩০ লাখ টাকা নেওয়া হয় এই টাকা কীভাবে বণ্টন হয় বা কারা নেয় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি বিভিন্নভাবে খরচ হয়, প্রশাসনকেও দিতে হয়।
কাপাসিয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও গাজীপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শাহ রিয়াজুল হান্নান বলেন, ডায়মন্ড হ্যাচারির লেয়ার মুরগির লিটার অপসারণের বিষয়টি আগে আওয়ামী লীগ নেতারা দেখতেন, এখন স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা দেখেন।