পিপির দপ্তরে বিক্ষুব্ধদের হানা
বরিশালে আওয়ামী সমর্থিত এপিপি নিয়োগে তোলপাড়
আকতার ফারুক শাহিন, বরিশাল
প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বরিশালের আদালতে নতুন নিয়োগ পাওয়া আইন কর্মকর্তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক থাকা নিয়ে তোলপাড় চলছে। কী করে তাদের নাম এই তালিকায় এলো তা জানতে পাবলিক প্রসিকিউটরের কক্ষে গিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীরা। ফ্যাসিস্ট সরকারের সমর্থক আখ্যা দিয়ে এদের বাদ দেওয়ার দাবি এবং তা না হলে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণার হুমকিও দিয়েছেন তারা।
এদিকে আইন কর্মকর্তাদের তালিকায় আওয়ামী লীগ সমর্থকদের নাম থাকা প্রশ্নে খানিকটা ভিন্ন মত জানিয়েছেন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের বরিশাল ইউনিট সভাপতি ও দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের পিপি অ্যাডভোকেট মহসিন মন্টু। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে তাদের অনেকেই কোনো দল করেন না বলে জানান তিনি। আওয়ামী লীগ আমলে এদের কেউ কেউ বাধ্য হয়ে সাদা দলকে সমর্থন করেছেন বলেও দাবি তার। তার পরও অভিযোগ যেহেতু উঠেছে তাই ফোরামের বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকেই বরিশালের আদালত অঙ্গনে শুরু হয় নতুন আইন কর্মকর্তা নিয়োগের প্রক্রিয়া। আওয়ামী লীগ সমর্থক জিপি, পিপি, এপিপিদের বাদ দিয়ে নতুন আইন কর্মকর্তা নিয়োগ প্রশ্নে মুখ্য ভূমিকায় নামে এখানকার বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের সংগঠন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম নেতারা।
তারাই যাচাই বাছাই করে একটি তালিকা পাঠান ঢাকায়। ২৯ অক্টোবর নতুন নিয়োগ পাওয়া ১৪৫ জন আইন কর্মকর্তার তালিকা বরিশালের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর পাঠায় আইন মন্ত্রণালয়। ওই তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পরপরই জটিলতা বাধে আদালত অঙ্গনে। তালিকায় ১১ জন আওয়ামী কর্মী-সমর্থকের নাম থাকায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা।
তাদের নাম আইন কর্মকর্তার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার দাবি নিয়ে বৃহস্পতিবার নবনিযুক্ত পিপি অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদের দপ্তরে যান তারা। সেখানে এদের বাদ না দিলে প্রয়োজনে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণারও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।
বিক্ষুব্ধ আইনজীবীরা জানান, ১১ জনের নাম আমরা পেয়েছি যারা সরাসরি ফ্যাসিস্ট সরকারের কর্মী-সমর্থক ছিল। এমনকি সদ্য সাবেক দু’জন এপিপিও আবার নতুন করে নিয়োগ পেয়েছেন। এরা হলেন আবুল বাশার কাজল ও মশিউর রহমান সোহেল। এছাড়া আওয়ামী সমর্থক অন্যরা হলেন জসিম উদ্দিন, সোহেলী আক্তার রনি, শাহ কামাল, খলিলুর রহমান মেহেদী, মাসুদ মিয়া, আসমা আঁখি, ফাহিমা সুলতানা, মুনিরা বেগম মুনমুন ও শফিউল্লাহ। অবশ্য এদের মধ্যে ফাহিমা সুলতানা নিজেকে আওয়ামী লীগের সমর্থক নয় দাবি করে লিখিত দিয়েছেন।
বরিশাল জেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ও আইনজীবী ফোরামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাফিজ আহম্মেদ বাবলু বলেন, ‘১৬ বছর ধরে যারা ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে তাদেরকে না দিয়ে আওয়ামী সমর্থক এসব আইনজীবীকে আইন কর্মকর্তা নিয়োগই কেবল নয়, এমন অনেককে এখানে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে যারা আদালত অঙ্গনে সুবিধাবাদী হিসাবে চিহ্নিত। অন্তত ১৫ জন আছেন যারা আওয়ামী লীগবিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে তো ছিলেনই না, বরঞ্চ আওয়ামী লীগের সিনিয়র আইনজীবীদের জুনিয়র হিসাবে থেকে সুবিধা লুটেছেন। সরাসরি এমন অনেকের নাম বলতে পারি যারা ৫ আগস্টের আগে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো আওয়ামী লীগের হয়ে চালিয়েছেন। যারা আমাদের বিরুদ্ধে মামলা চালাল, আমাদের জেলে পাঠালেন, তারা কী করে এখন আইন কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পাচ্ছেন?’
অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি পদে নিয়োগ পাওয়া সাবেক ছাত্রদল নেতা ও আইনজীবী ফোরামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহমুদ হোসাইন আল মামুন বলেন, ‘আইন পেশায় দক্ষ ও আওয়ামী লীগ বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামের পরীক্ষিত অনেক আইনজীবী আছেন আদালত প্রাঙ্গণে। তাদের না দিয়ে আওয়ামী সমর্থক কর্মীদের আইন কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি সত্যিই দুঃখজনক।’ অতিরিক্ত স্পেশাল পিপি পদে নিয়োগ পাওয়া আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এসএম সরোয়ার হোসেন বলেন, ‘যতদূর শুনেছি লবিং তদবির করে এদের নাম ঢুকানো হয়েছে। তবে বিষয়টি দুঃখজনক। আমরা এরই মধ্যে আমাদের পিপি, আইনজীবী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদের সাথে দেখা করে অভিযোগ জানিয়েছি। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন বিষয়টি দেখার।’
পরিচয় না প্রকাশের শর্তে আইনজীবী ফোরামের আরেক নেতা বলেন, ‘নতুন নিয়োগ পাওয়া এই সরকারি কর্মকর্তাদের তালিকায় এমন আইনজীবীও আছেন যিনি মাদক মামলায় দফায় দফায় গ্রেফতার হয়েছেন। এমনকি তার আইনজীবী সমিতির সদস্যপদ পর্যন্ত স্থগিত হয়েছে মাদক বাণিজ্যের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে। অথচ তাকেও করা হয়েছে অতিরিক্ত পিপি।’ জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক, আইনজীবী ফোরামের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট মো. শহিদ হোসেন বলেন, ‘টানা ১৬ বছর এই আদালত প্রাঙ্গণে মুখবুজে অত্যাচার সইতে হয়েছে। সমিতির নির্বাচনে প্রতিবার জোর করে ফলাফল কেড়ে নেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের সেই সময়গুলোতে যারা সাদা ক্যাপ পরে আমাদের ব্যঙ্গবিদ্রূপ করেছে তারাই আজ আবার আইন কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পেয়েছে। এটা কোনো অবস্থাতেই মানা হবে না।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি পদে নিয়োগ পাওয়া জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘কিছু ভুলত্রুটি হয়তো হয়েছে, তবে সেটা আমাদের দিক থেকে নয়। আমরা সঠিক আইনজীবীদের তালিকাই পাঠিয়েছিলাম ঢাকায়। তা ছাড়া আদালত প্রাঙ্গণে মামলা পরিচালনা প্রশ্নে কিন্তু সবার আগে জরুরি দক্ষতা এবং যোগ্যতা। সরকারি নিয়ম বিধিরও কিছু বিষয় রয়েছে। সেসব মেনেই আমরা তালিকা পাঠিয়েছিলাম। তার পরও যেহেতু অভিযোগ এসেছে সেটা খতিয়ে দেখে ঢাকায় চিঠি দেওয়া হবে।’
ফোরামের সভাপতি অ্যাডভোকেট মহসিন মন্টু বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আমলে জোর করে সাদা ক্যাপ পরিয়ে কাজ করতে বাধ্য করার মতো ঘটনাও কিন্তু আছে। যাদের কথা বলা হচ্ছে তাদের মধ্যে কয়েকজন বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগ কিছুই করে না। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত করে বলছি যে, বরিশাল থেকে আমাদের পাঠানো তালিকায় এদের কারও নাম ছিল না। হয়তো মন্ত্রণালয়ে তদবির করে এরা নিজেদের নিয়োগ নিশ্চিত করেছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা শিগগিরই ফোরামের সভা করব। সেখানে তালিকা যাচাই বাছাই করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ প্রসঙ্গত, নিয়োগ পাওয়া ১৪৫ আইন কর্মকর্তার মধ্যে পাঁচজন রয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর। এছাড়া ইসলামী আন্দোলনের একজন আইনজীবীও রয়েছেন। ১২৮ জনই বিএনপির।