Logo
Logo
×

শেষ পাতা

বিচার বিভাগ পৃথক্করণ দিবস আজ

১৭ বছরেও হয়নি পৃথক সচিবালয়

কাগজে-কলমে আলাদা হলেও বাস্তবে সরকারের মুখাপেক্ষী * প্রধান বিচারপতির উদ্যোগে সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে পৃথক সচিবালয় গঠনসংক্রান্ত প্রস্তাব

আলমগীর মিয়া

আলমগীর মিয়া

প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

১৭ বছরেও হয়নি পৃথক সচিবালয়

আজ ১ নভেম্বর বিচার বিভাগ পৃথক্করণ দিবস। আলোচিত মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এক অধ্যাদেশ জারি করে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করা হয়। কিন্তু ১৭ বছরেও বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের উদ্যোগে আলাদা সচিবালয় গঠনসংক্রান্ত একটি প্রস্তাব সম্প্রতি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও কাগজে-কলমে বিচার বিভাগ আলাদা হলেও বাস্তবে এখনো আইন মন্ত্রণালয় ও সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে রয়েছে বলে মনে করছেন আইনজ্ঞরা। তাদের অভিমত-১৯৭২ সালের সংবিধানে অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ছিল কেবল সুপ্রিমকোর্টের হাতে। এখন সংবিধান পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগ ও সুপ্রিমকোর্ট-এ দ্বৈত নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা চালু আছে। বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে মন্ত্রণালয়। এজন্য স্বাধীনতা ব্যাহত হচ্ছে। পৃথক্করণ পুরোপুরি হয়নি। সুপ্রিমকোর্টের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আনলে বিচার বিভাগের পৃথক্করণ সম্পন্ন হবে এবং তা পুনরুদ্ধার হবে। দেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পরই প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কার্যকর ভূমিকা নেন। সেই লক্ষ্যে ২১ সেপ্টেম্বর সুপ্রিমকোর্টে দেশের অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশে অভিভাষণ প্রদান করেন। ওই অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, সুপ্রিমকোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতি, বিচার বিভাগ সংস্কারসংক্রান্ত কমিশনের চেয়ারম্যান আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, অ্যাটর্নি-জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানসহ সুপ্রিমকোর্ট বারের সভাপতি ও সেক্রেটারি উপস্থিত ছিলেন।

সেদিন প্রধান বিচারপতি তার অভিভাষণে দেশের বিচার বিভাগের জন্য একটি রোডম্যাপ তুলে ধরেন, যাতে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্বতন্ত্রকরণ ও প্রাতিষ্ঠানিক পৃথক্করণের বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়। অভিভাষণে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় স্থাপনের জন্য তিনি শিগগিরই পদক্ষেপ নেবন। এরই ধারাবাহিকতায় সুপ্রিমকোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিদের মতামত গ্রহণপূর্বক বিচার বিভাগের জন্য একটি পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠনসংক্রান্ত প্রস্তাব ২৭ অক্টোবর আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।

প্রধান বিচারপতির এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেডআই খান পান্না যুগান্তরকে বলেন, দেরিতে হলেও বর্তমান প্রধান বিচারপতি আলোর মুখ দেখিয়েছেন। এখন মন্ত্রণালয় আন্তরিক হলেই এর সমাধান হবে। তিনি বলেন, সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন হিসাবে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এমনকি ১১৬(ক) অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতের বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেটরাও দায়িত্ব পালনে স্বাধীন হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সংবিধানে সম্পূর্ণ স্বাধীন বলা হলেও অধস্তন আদালতের কর্তৃত্ব এখনো অনেকাংশেই আছে নির্বাহী বিভাগের হাতে। সুপ্রিমকোর্ট এখানে পরামর্শক হিসাবে কাজ করে। এক্ষেত্রে সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে শৃঙ্খলার দায়িত্ব হাইকোর্ট বিভাগের ওপর ন্যস্ত করার কথা থাকলেও ১১৬ অনুচ্ছেদে নিয়ন্ত্রণ শৃঙ্খলার দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির হাতে। এখানে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগ দায়িত্ব পালন করলেও সুপ্রিমকোর্ট আছে পরামর্শকের ভূমিকায়।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পরিপূর্ণতা পায়নি। এটিকে আওয়ামী লীগ সরকার কুক্ষিগত করে রেখেছিল। মাসদার হোসেন মামলার আলোকে সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা বারবার তাগিদ দিলেও পরে আর সেটি টিকল না। পৃথক সচিবালয় থেকে শুরু করে নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি নিয়ে বারবার সিনহা সাহেব তাগিদ দিলেও কোনো কাজ হয়নি। তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠনসংক্রান্ত যে প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন, এটিকে আমি সাধুবাদ জানাই। আশা করি, বর্তমান সরকার কার্যকরি ভূমিকা রাখবে। 

দেশের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক চেয়ে ১৯৯৪ সালে এ মামলা করেছিলেন জেলা জজ ও জুডিশিয়াল অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন মহাসচিব মাসদার হোসেন। তিনি এখন অবসরে রয়েছেন। এ মামলার চূড়ান্ত শুনানি করে ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করতে ঐতিহাসিক এক রায় দেন। ওই রায়ে সর্বোচ্চ আদালত বিসিএস (বিচার) ক্যাডারকে সংবিধান-পরিপন্থি ও বাতিল ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে জুডিশিয়াল সার্ভিসকে স্বতন্ত্র সার্ভিস ঘোষণা করা হয়। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করার জন্য সরকারকে ১২ দফা নির্দেশনা দেন আপিল বিভাগ। মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পর ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হয়ে বিচার বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। পরে ২০১৬ সালের ৭ মে আইন মন্ত্রণালয় নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধিমালার একটি খসড়া প্রস্তুত করে সুপ্রিমকোর্টে পাঠায়। সরকারের খসড়াটি ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার অনুরূপ হওয়ায় তা মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপন্থি বলে ওই বছর ২৮ আগস্ট শুনানিতে বলেন আপিল বিভাগ। 

মাসদার হোসেন মামলার অন্যতম দরখাস্তকারী সাবেক জেলা জজ মো. মাসদার হোসেন ২৫ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতির প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের সঙ্গে সুপ্রিমকোর্টে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।

সাক্ষাৎকালে তিনি দেশের অধস্তন আদালতের বিচারকদের পক্ষে মাসদার হোসেন মামলা পরিচালনায় অন্যতম আইনজীবী প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের বাবা প্রয়াত ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদের অবদান সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করেন। তিনি উল্লেখ করেন, সম্পূর্ণ স্বতঃপ্রণোদিতভাবে সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে মামলাটি পরিচালনা করে বিচার বিভাগ পৃথক্করণে ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ যে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন, সেই অবদানকে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যরা আজও কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন।


Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম