বিচারকাজ থেকে বিরত থাকা
১৫ বিচারপতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত জুডিশিয়াল কাউন্সিলে
আপাতত তারা বিচারকাজ থেকে বিরত রয়েছেন * থাকা-না-থাকা সুপ্রিমকোর্টের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের ওপর নির্ভর করবে -রেজিস্ট্রার জেনারেল
আলমগীর মিয়া
প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিচারকাজ থেকে বিরত থাকা হাইকোর্ট বিভাগের ১৫ বিচারপতির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত সুপ্রিমকোর্ট থেকে এখনো আসেনি। সর্বশেষ আপিল বিভাগে রিভিউ নিষ্পত্তি করে বিচারপতি অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল থাকলেও রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি বের হয়নি। আইনজীবীদের মতে, এতদিন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রয়োগ নিয়ে আইনি জটিলতা থাকায় বিষয়টি ঝুলে ছিল। এখন সর্বোচ্চ আদালতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল থাকায় বিচারপতিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে আইনি কোনো বাধা নেই। তবে রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি প্রকাশের আগে বিচারকাজ থেকে বিরত থাকা বিচারপতিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আপাতত প্রয়োগ হচ্ছে না। রিটকারী জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদের দাবি, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল যেহেতু আগেই বহাল ছিল, তিন বিচারপতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত আগেই নেওয়া যেত। এখনো রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কারণ, তাদের অভিযোগের বিষয়টি আগেই রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করেছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, কিছু আইনজীবীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ১২ বিচারপতিকে সম্প্রতি বিচারকাজ থেকে বিরত রাখা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ এখনো আসেনি। যদি আসে, তাহলে তাদের বিষয়টি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে যেতে পারে।
জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমেদ ভূঞা যুগান্তরকে বলেন, ‘আপিল বিভাগে রিভিউ নিষ্পত্তির রায়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল হয়েছে। ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি বের হলে বিস্তাড়িত জানা যাবে।’ তিনি বলেন, ‘এতদিন একটা অচলাবস্থা ছিল। এখন যেহেতু সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত এসেছে, আগের তিন বিচারপতিসহ সবই বিবেচনায় আসবে। আমি এ বিষয়ে তেমন কিছু জানি না। থাকা-না-থাকা সবকিছু সুপ্রিমকোর্টের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের ওপর নির্ভর করবে।’
২০১৯ সালের ১৬ মে নিয়মবহির্ভূতভাবে নিম্ন আদালতের মামলায় হস্তক্ষেপ করে ডিক্রি পালটে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল হাইকোর্টের বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি একেএম জহিরুল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চের বিরুদ্ধে। ২০১৯ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সুপ্রিমকোর্টের মুখপাত্র ও স্পেশাল অফিসার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘হাইকোর্টের তিনজন বিচারপতির বিরুদ্ধে প্রাথমিক অনুসন্ধানের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরামর্শক্রমে তাদের বিচারকার্য থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্তের কথা অবহিত করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে তারা ছুটির প্রার্থনা করেন।’ ওই তিনজন হলেন-বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী, বিচারপতি একেএম জহিরুল হক ও বিচারপতি কাজী রেজাউল হক। কী কারণে বা কী অভিযোগে তাদের বিচারকাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে, তা জানানো হয়নি।
৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলে তার আমলে নিয়োগকৃত হাইকোর্ট বিভাগে কর্মরত ৩০ বিচারপতিকে দুর্নীতিবাজ, দলকানা আখ্যা দিয়ে তাদের অবিলম্বে পদত্যাগ বা অপসারণ চান সুপ্রিমকোর্টের একদল আইনজীবী। সর্বশেষ ৭ অক্টোবর হাইকোর্ট বিভাগের এসব দলবাজ বিচারপতিকে ১৮ অক্টোবরের মধ্যে পদত্যাগ বা অপসারণ চেয়ে প্রধান বিচারপতি বরাবর স্মারকলিপি দেন আন্দোলনকারীরা। এদিকে ১৬ অক্টোবর ‘দলবাজ’ ও ‘দুর্নীতিবাজ’ বিচারপতিদের পদত্যাগ অথবা তাদের অপসারণের দাবিতে হাইকোর্ট ঘেরাও এবং বিক্ষোভ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বৈষম্যবিরোধী আইনজীবী সমাজ ও জাতীয় নাগরিক কমিটি-লিগ্যাল উইং। বিক্ষোভের মুখে হাইকোর্ট বিভাগের ১২ জন বিচারপতিকে আপাতত বেঞ্চ না দেওয়া, অর্থাৎ বিচারকাজ থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্তের কথা জানায় সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন। ১৭ অক্টোবর ১২ জন বিচারপতিকে বাদ দিয়ে বেঞ্চ গঠন করা হয়। তারা হলেন বিচারপতি এসএম মনিরুজ্জামান, বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামান, বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দিন, বিচারপতি মো. আখতারুজ্জামান, বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলাম, বিচারপতি এসএম মাসুদ হোসাইন দোলন, বিচারপতি আতাউর রহমান খান, বিচারপতি নাইমা হায়দার, বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ, বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার, বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাস ও বিচারপতি খিজির হায়াত।
৩০ বিচারপতি অপসারণের আন্দোলনে যুক্ত আছেন সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মহসীন রশিদ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমরা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছি, তাদের একটা প্রসেসের মাধ্যমে অপসারণ করতে হবে। এখন তো জুডিশিয়াল কাউন্সিল সুপ্রিমকোর্টে বহাল হয়েছে। যদি তাদের বিরুদ্ধে জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রয়োগ হয়, তাহলে সুনির্দিষ্ট আকারে অভিযোগ আনতে হবে। এজন্য আমাদের বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আন্দোলনকারী আইনজীবী মামুন মাহবুব যুগান্তরকে বলেন, ৩০ জনের মধ্যে প্রধান বিচারপতি ১২ জনকে বিচারকাজ থেকে বিরত রেখেছেন। এ ১২ জনের মধ্যে ১০ জন আমাদের তালিকার। প্রধান বিচারপতি অত্যন্ত আন্তরিক, এতে আমরা খুশি। তিনি বলেন, আরও ১০/১২ জন বিচারপতি রয়েছেন, যারা দুর্নীতি ও দলবাজের সঙ্গে জড়িত। ফ্যাসিবাদের দোসর। আশা করব, তারা সবাই যেন পদত্যাগ করেন। না হলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল যেন প্রয়োগ হয়।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে অভিযোগ নিষ্পত্তি প্রসঙ্গে মনজিল মোরসেদ বলেন, কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে সেটি যাবে রাষ্ট্রপতির কাছে। পরে সেটি প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠালে তিনিসহ (প্রধান বিচারপতি) আরও দুজন বিচারপতি নিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তা তদন্ত করবেন। তাদের ডাকবেন, কথা বলবেন, তদন্ত করে আত্মপক্ষ সমর্পণের সুযোগ দেবেন। যদি মনে করেন, অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে, তখন সুপারিশ দিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। রাষ্ট্রপতি সেটি গেজেট আকারে জারি করবেন।
বিচারপতিদের অপসারণের এ ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে নিতে ১০ বছর আগে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী এনেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ। পরবর্তী সময়ে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। ২০১৭ সালে রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। গত ২০ অক্টোবর সেই আবেদন পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ রায় দেন। রায়ে সংবিধানের এ সংক্রান্ত ৯৬ অনুচ্ছেদের ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭ ও ৮ উপ-অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করা হয়। এখন থেকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণ করা যাবে। এ রায়ের ফলে কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনে অসমর্থ বা গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ উঠলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। আর রাষ্ট্রপতির উদ্দেশ্যে নিজের সই করা পত্র দিয়ে কোনো বিচারক চাইলে পদত্যাগ করতে পারবেন। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হয় প্রধান বিচারপতি ও পরবর্তী জ্যেষ্ঠ দুজন বিচারপতিকে নিয়ে।