গুমসংক্রান্ত কমিশনে অভিযোগ
১১ বছর অপেক্ষায় ব্যবসায়ী কুদ্দুসের পরিবার
গুমের অভিযোগের তির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যের দিকে
ইমন রহমান
প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাজধানীর মিরপুরের পল্লবী থানা এলাকা থেকে অপহৃত হন ব্যবসায়ী মো. কুদ্দুসুর রহমান চৌধুরী। সাদা পোশাকে একদল লোক তাকে তুলে নিয়ে যায়। পরিবারের দাবি অপহরণকারীরা কুদ্দুসের পূর্বপরিচিত। এ সময় কুদ্দুসের সঙ্গে থাকা ভাতিজা মোহাম্মদ সাজাহান অপহরণকারীদের চিনতেও পেরেছিলেন। ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি তুলে নেওয়ার পর থেকে এখনো ফিরে আসেননি এই ব্যবসায়ী।
বেঁচে আছেন না মারা গেছেন তাও জানেন না স্বজনরা। ঘটনার পর পল্লবী থানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৬ সদস্যের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন কুদ্দুসুর রহমানের স্ত্রী মোছা. জোসনা বেগম। মামলাটি থানা পুলিশের পর পুলিশের বিশেষায়িত দুটি সংস্থা তদন্ত করেছে। কিন্তু কোনো হদিস মেলেনি তার। অভিযুক্তদের আইনের আওতায়ও আনা যায়নি।
নিখোঁজ কুদ্দুসুর রহমানের পরিবারের দাবি, রিয়েল এস্টেট কোম্পানির সঙ্গে জমিজমাসংক্রান্ত বিরোধের জেরে অপহৃত হন কুদ্দুস। আর ওই রিয়েল এস্টেট কোম্পানির মালিকানায় আছেন সাবেক এক প্রভাবশালী সেনা কর্মকর্তা। ফলে মামলা করলেও আওয়ামী লীগের আমলে প্রভাব খাটিয়ে সঠিক তদন্ত করতে দেওয়া হয়নি। প্রথমে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ ও পরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এজাহারনামীয় আসামিদের কোনো জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই তাদের নাম বাদ দিয়ে আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) জমা দিয়েছেন।
এ বিষয়ে পিবিআইর তদন্ত কর্মকর্তা এসআই (বর্তমানে জেলা পুলিশে বদলি) মো. শাহীন যুগান্তরকে বলেন, মামলাটি ডিবি তদন্ত করে একজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দিয়েছিল। বাদীর নারাজির প্রেক্ষিতে পিবিআইতে আসে। আমি তদন্ত করে ওই একজনকেই আসামি করে চার্জশিট দিয়েছি। এজাহারনামীয় আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ না করার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এজাহারনামীয় আসামিরা উচ্চ আদালত থেকে জামিনে ছিলেন। এ কারণে আইনগতভাবে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের কোনো সুযোগ ছিল না।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত গুমসংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারিতে অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ী কুদ্দুসের মেয়ে ফারজানা আক্তার টুম্পা। ২৪ সেপ্টেম্বর এ অভিযোগ করেন তিনি।
সেই অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালে কর্নেল (অব.) পদমর্যাদার এক কর্মকর্তার নেতৃত্বে র্যাব-৪ এর একজন কর্নেল, একজন ক্যাপ্টেন চোখ বেঁধে কুদ্দুসুর রহমানকে উঠিয়ে নিয়ে যান। ইলেকট্রিক শক দিয়ে ৪টি গাড়ি, ৯ কোটি ৬০ লাখ টাকার চেক, ২ লাখ টাকা এবং জমির দলিলে সই নেন। এ ব্যাপারে পরে সংবাদ সম্মেলন করেন কুদ্দুসুর রহমান। হাইকোর্টে রিট পিটিশনও দায়ের করেন।
মামলা চলমান থাকা অবস্থায় ২০১৪ সালের জানুয়ারির ১ তারিখে মিরপুর জান্নাতুল মাওয়া কবরস্থানের সামনে থেকে সাদা মাইক্রোবাসে জোরপূর্বক উঠিয়ে নিয়ে যায় কুদ্দুসুর রহমানকে। এখনও কোনো খোঁজ মেলেনি তার। ২০১৩ সালে মিরপুরের র্যাব-৪-এ কর্মরত অফিসারদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে তার বাবাকে খুঁজে দেওয়ার আকুতি জানান টুম্পা।
অভিযুক্ত ব্যক্তি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রভাবশালী হলে তাদের বিষয়ে কিভাবে তদন্ত করবে গুমসংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারি-এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কমিশনের এক সদস্য যুগান্তরকে বলেন, ‘অভিযুক্ত ব্যক্তি যত ক্ষমতাধরই হোক, যে বাহিনীরই হোক তাদের ডাকার ক্ষমতা কমিশনের আছে।’
সম্প্রতি রাজধানীর গুলশানে গুমসংক্রান্ত কমিশনের কার্যালয়ের সামনে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় নিখোঁজ কুদ্দুসুর রহমানের মেয়ে ফারজানা আক্তার টুম্পার। অভিযোগ করার পর কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে খোঁজ নিতে আসেন তিনি। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন মা মোছা. জোসনা বেগমও। তারা পুরো ঘটনার বর্ণনা দেন। একই সঙ্গে গত ১১ বছর আতঙ্কে জীবন পার করার কথাও তুলে ধরেন।
টুম্পা যুগান্তরকে বলেন, আমার আব্বু জমির ব্যবসা করতেন। ২০০৯ সালে একটা জমি বিক্রি করেছিলেন এক কর্নেলের (অব.) (তদন্তের স্বার্থে নাম অপ্রকাশিত) কাছে। তখন আমার আব্বু জমিটা তাকে দখল দিয়ে রেজিস্ট্রি করে বুঝিয়ে দেন। ২০১২ সালের দিকে জমিটা বেদখল হয়। এখান থেকেই সমস্যার সূত্রপাত।
এরপরই র্যাব-৪ এর লোক দিয়ে ২০১২ সালের মে মাসের দিকে আমার আব্বুকে মারধর করে উঠিয়ে নিয়ে যায়। ইলেকট্রিক শক দেয়, টর্চার করে। পরে জোর করে চেকে স্বাক্ষর করায়, গাড়ি ও টাকা-পয়সা নিয়ে ছেড়ে দেয়। এরপর আব্বু অনেকদিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। একই বছরের জুলাইয়ে আব্বু হাইকোর্টে রিট করে গাড়ি উদ্ধারের অনুমতি পান।
এছাড়া ওই কর্নেলের (অব.) বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেসও করেন। পরে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সাংবাদিক সম্মেলন করেন আব্বু। ৩২টি পত্রিকাতে সেই নিউজ ছাপা হয়। এরপর মামলা চলতে থাকে। আমাদের পক্ষেই ছিল সব। র্যাবের অভিযুক্তদের চাকরি চলে যাওয়ার অবস্থা হয়। আদালতের মাধ্যমে গাড়িও উদ্ধার করি আমরা।
অপহরণের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে টুম্পা বলেন, ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি আমার আব্বুর ব্যক্তিগত সহকারী হুক্কু সাত্তার ফোন দিয়ে বলেন একটি জমি বায়না হবে। আপনি বায়না করে দিয়ে যান এবং ৩০ লাখ টাকার চেক নিয়ে যান। আব্বু বুঝতে পারেননি হুক্কু সাত্তারও তার শত্রু পক্ষের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন।
হুক্কু সাত্তার বিহারি। থাকতেন রাজধানীর মিরপুরে। আব্বুর জমিগুলো তিনিই বিক্রি করে দিতেন। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় খিলগাঁওয়ের বাসা থেকে প্রাইভেটকারে হুক্কু সাত্তারের কথামতো মিরপুর বাঙলা স্কুলের পাশে জান্নাতুল মাওয়া কবরস্থানের কাছে যান। সেখানে গাড়িতে বসে ড্রাইভারকে পাঠান হুক্কু চাচাকে ডেকে আনতে।
আব্বু সেখানে পৌঁছানোর দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যেই পেছনের একটি মাইক্রোবাস (হাইয়েস গাড়ি সাদা রংয়ের) থেকে সাদা পোশাকে ৪-৫ জন হাতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে নেমে আসে। ওরা জোর জবরদস্তি করে গাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে নিয়ে যায় আব্বুকে। আব্বুর গাড়িতেই ছিল আমার চাচাতো ভাই মোহাম্মদ সাজাহান। তাকে নেয়নি। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত আমার বাবার কোনো সন্ধান পাইনি আমরা।
টুম্পা বলেন, এ ঘটনায় করা মামলাটি সঠিক তদন্ত করেনি পুলিশ। শুধু হুক্কু সাত্তারের নাম দিয়ে চার্জশিট দেয়। অথচ যাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগ, আব্বু নিজে যাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন, তাদের ধরে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সব বের হয়ে আসত। কিন্তু ডিবি ও পিবিআই তা করেনি। বর্তমান সরকার আমার বাবাকে খুঁজে দেবে বলে আমি বিশ্বাস করি।