Logo
Logo
×

শেষ পাতা

পুরান ঢাকার উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা

অনুদানের ফাঁদে চড়া সুদের ঋণ দেওয়ার কৌশল

অনুদানের পর ৬% সুদে ঋণ দিতে চায় এআইআইবি, বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ইআরডিকে দায়িত্ব দিল পরিকল্পনা কমিশন * অনুদান নিলে ঋণ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়-কাজী শফিকুল আজম

Icon

হামিদ-উজ-জামান

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অনুদানের ফাঁদে চড়া সুদের ঋণ দেওয়ার কৌশল

ছোট প্রকল্পের জন্য ৩ মিলিয়ন ডলার অনুদান নিলে সংশ্লিষ্ট বড় প্রকল্পে ২০ কোটি ডলার ঋণ নিতে গুনতে হবে ৬ শতাংশ সুদ। ঋণদাতা এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি)। তাদের এ সুদের হার আন্তর্জাতিক পর্যায়ের এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। এখন প্রশ্ন হলো-সরকার এরকম অনুদানের ফাঁদে পা দিয়ে এ ঋণ নেবে কি না। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত প্রকল্প প্রস্তাবনা নিয়ে ১ অক্টোবর পরিকল্পনা কমিশনে পর্যালোচনা বৈঠক হয়। ১৬ অক্টোবর অনুমোদিত হয় কার্যবিবরণী। এরপর বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্ত মোতাবেক ইআরডি এবং গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে-ছোট প্রকল্পে অনুদান নিলে বড় প্রকল্পের জন্য এআইআইবি থেকে ঋণ নেওয়া বাধ্যতামূলক কি না।

সূত্র জানায়, পুরান ঢাকা ও গাবতলী উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা হাতে নিতে যাচ্ছে সরকার। এর অংশ হিসাবে প্রাথমিক পর্যায় হিসাবে ‘ঢাকা আরবান রিজেনারেশন কারিগরি সহায়তা’ নামের একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৩ কোটি ৪ লাখ টাকা। এটি সম্পূর্ণ এআইআইবির অনুদান থেকে খরচ করা হবে। প্রক্রিয়া শেষে প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে চলতি বছর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। প্রকল্পের আওতায় পুরান ঢাকার জন্য সুসংহত নগর পুনর্গঠন ও দূষণ প্রতিকার নীতিমালা তৈরি করা হবে। এছাড়া প্রস্তাবিত বিভিন্ন সাইটের মূল্যায়ন, সমন্বিত দূষণ প্রতিকার ও পুনঃউন্নয়ন কৌশল, সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, পরিবেশগত এবং সামাজিক মূল্যায়নের জন্য বিশদ নকশা তৈরি করা হবে।

প্রস্তাবিত প্রকল্পটি নিয়ে ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (এসপিইসি) সভা। এতে সভাপতিত্ব করেন পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) সোলেমান খান। সভায় এআইআইবির অনুদান এবং পরামর্শকসহ অন্যান্য বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশি-বিদেশি মিলে ১১৫ জন প্রকল্পের বহর যুক্ত করা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়।

জানতে চাইলে ইআরডির সাবেক সিনিয়র সচিব কাজী শফিকুল আজম রোববার যুগান্তরকে বলেন, নীতিগতভাবে একটি বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়। কেননা অনুদান নেওয়ার আগেই অলিখিত হলেও একটি শর্ত থাকে তাদের কাছেই ঋণ নেওয়ার। সেটি না হলে তাদের অনুদান প্রাথমিক কাজ করে অন্য সংস্থার ঋণ নিলে তাদের তো কোনো লাভ হয় না।

এসপিইসি সভায় রাজউকের উপ-নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, একসময় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল পুরান ঢাকা। বর্তমানে পুরান ঢাকার অধিকাংশ এলাকা আধুনিক নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত এবং জরাজীর্ণ ভবন, অপ্রশস্ত রাস্তা, জলাবদ্ধতাসহ নানা অব্যবস্থাপনার কারণে অনেক এলাকা পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। এছাড়া বহু জায়গায় বাসাবাড়িতে কেমিক্যাল গোডাউন বা রাসায়নিক পণ্যের গুদাম রয়েছে। এসব রাসায়নিক পদার্থ আগুনের সংস্পর্শ পেলেই ঘটতে পারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। ওই এলাকার বিভিন্ন অলিগলিতে গড়ে উঠেছে অনেক কারখানাও। অন্যদিকে হাজারীবাগ এলাকায় যখন ট্যানারিশিল্প ছিল, তখন ট্যানারি কারখানা থেকে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক বর্জ্য তৈরি হতো; যা কোনোরকম শোধন ছাড়াই বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলা হতো। ফলে নদীর পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়েছে। এছাড়া ট্যানারি এলাকার মাটি ও বায়ু ব্যাপকভাবে দূষিত হয়েছে, যা ওই এলাকা ও আশপাশে বসবাসকারী জনগণের জন্য নানা স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ। এ সমস্যা দূর করার জন্য রাজউক ২০১৪ সাল থেকে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা আরবান রিজেনারেশন কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের পিডিপিপি (প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) অনুমোদন পায়। পরে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) পরামর্শ অনুযায়ী রাজউক ২০২২ সালের ১৪ এপ্রিল এআইআইবির প্রজেক্ট প্রিপারেশন স্পেশাল ফান্ডের (পিপিএসএফ) জন্য আবেদন করে। ইআরডি রাজউককে জানায়, এআইআইবি ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দিচ্ছে। পাশাপাশি ঢাকা অবকাঠামো পরিকল্পনা (২০১৬-২০৩৫) এবং বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (২০২২-২০৩৫) প্রস্তাব অনুযায়ী প্রকল্প এলাকা চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে পুরান ঢাকার হাজারীবাগ, ইসলামবাগ, লালবাগ, চকবাজার, মৌলভীবাজার, বংশাল, কামরাঙ্গীরচরকে প্রকল্পভুক্ত করা হয়। এছাড়া নতুন ঢাকার মধ্যে গাবতলী পূর্ব ও পশ্চিম এলাকাকেও ধরা হয়েছে। প্রাথমিক প্রকল্পের পর এআইআইবি থেকে ২০ কোটি ডলার বা প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে একটি বড় প্রকল্প নেওয়া হবে।

এসপিইসি সভায় ইআরডির প্রতিনিধি বলেন, এ প্রকল্পের জন্য ২০ কোটি ডলার দেবে এআইআইবি। এজন্য প্রাথমিক প্রকল্পে ৩ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছে। এআইআইবির সুদের হার বাজার দরের ওপর নির্ভর করে। বর্তমানে এ হার ৪ দশমিক ৮০ শতাংশ থেকে ৫ দশমিক ৩৯ শতাংশে উঠেছে। তিনি আরও বলেন, এআইআইবি একটি উচ্চ সুদের বাণিজ্যিক ব্যাংক। এর সুদের হার ও আনুষঙ্গিক খরচ হিসাব করলে ৬ শতাংশের বেশি দাঁড়ায়। তাই যেসব সংস্থার সুদের হার কম, সেখান থেকে ঋণ নেওয়া যৌক্তিক হবে। এছাড়া প্রকল্পটি বাণিজ্যিকভাবে সফল হবে কি না, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় তা পুনঃপরীক্ষা করতে পারে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, প্রকল্পের অনুকূলে অনুদান নিলে পরবর্তী সময়ে ঋণ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা তৈরি হবে কি না, বিষয়টি ইআরডি পরীক্ষা করবে।

প্রকল্পের পরামর্শক সম্পর্কে জানা যায়, প্রকল্পের প্যাকেজ-১ এবং প্যাকেজ-২ থেকে দুটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করা হবে। ওই প্রতিষ্ঠানের আওতায় প্যাকেজ-১-এর অধীন কিপার্সন হিসাবে ২৪ জন, নন কিপার্সন হিসাবে ৪৪ জন পরামর্শক থাকবে। প্যাকেজ-২-এর অধীন কিপার্সন ২০ জন, নন কিপার্সন ২৭ জন থাকবেন। পরামর্শক থাকবেন ১১৫ জন। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরামর্শক নিতে এআইআইবির সুপারিশ থাকলে নেওয়া হবে।

এসপিইসি সভায় রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় হাজারীবাগ থেকে স্থানান্তরিত ট্যানারিশিল্পের ৬১ একর জমি ১৬টি ব্লকে ভাগ করা হবে। এ বিষয়ে স্থানীয় জনগণ প্রকল্পের সঙ্গে থাকবেন বলে জানিয়েছেন। এর আওতায় কোনো ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে না। কিন্তু স্থানীয় ভূমির মালিকদের জমির বিপরীতে ব্যাংক ঋণ আছে। তবে কী পরিমাণ জমি বন্ধক আছে এবং কত টাকা ঋণ আছে, সেগুলো এখনো জানা যায়নি। এ অবস্থায় প্রকল্পের মূল চ্যালেঞ্জ হলো ব্যাংক ঋণের শর্ত ও ভূমি দখলমুক্ত করা।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম