সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদনে গোঁজামিল
প্রকল্প থেকে আয়ের হিসাব প্রশ্নবিদ্ধ
সংশোধনের জন্য সুপারিশসহ মন্ত্রণালয়ে ফেরত যাচ্ছে ডিপিপি
বাস্তবায়নের পর প্রকল্প থেকে যে আয় হবে সেক্ষেত্রে গোঁজামিল হিসাব দেওয়া হয়েছে। ‘৩টি পার্বত্য জেলায় সমন্বিত প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন’ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় আয়-ব্যয়ের বিশ্লেষণে বড় ধরনের গোঁজামিল খুঁজে পেয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। সেই সঙ্গে মানা হয়নি এমটিবিএফ (মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামো) সিলিং বা সীমা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৬৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা। অনুমোদন পেলে এটি চট্টগ্রাম বিভাগের ২৬টি উপজেলার ১২৮টি ইউনিয়নে বাস্তবায়র করবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। প্রস্তাবটি নিয়ে মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা। এতে সভাপতিত্ব করেন পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) জাহাঙ্গীর আলম।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য হলো দেশের তিনটি পার্বত্য জেলায় (রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি) প্রাণিজ আমিষের উৎপাদন বৃদ্ধি করা। প্রস্তাবিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে প্রকল্পের একটি ফিজিবিলিটি স্টাডি (সম্ভাব্যতা সমীক্ষা) প্রতিবেদন সংযুক্ত করা হয়েছে। এই ফিজিবিলিটি স্টাডি বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান করেছে। স্টাডিটির আয়-ব্যয় বিশ্লেষণ অধ্যায়ের টেবিলে যে তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে সেটি পূর্ণাঙ্গ নয়। এতে দেখা যায়, প্রকল্প শেষে অর্থাৎ ৪ বছর পর পঞ্চম বছর আরও অতিরিক্ত ৩৭৪ কোটি ৭৯ লাখ টাকা ব্যয় করা হলে প্রকল্প থেকে আয় হবে ৬৩৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। একইভাবে পরবর্তী বছরগুলোতে অর্থাৎ ৬ থেকে ১০ বছরের প্রতিবছর আরও অতিরিক্ত ৩২৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ব্যয় করা হলে প্রতিবছর ৬৭৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা আয় হবে। কিন্তু এ আয় প্রকল্পের কোন কোন খাত থেকে কিভাবে হবে তার কোনো হিসাব প্রতিবেদনে দেওয়া হয়নি। এছাড়া এই আয়ের জন্য প্রতিবছর অতিরিক্ত যে ৩২৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ব্যয় করতে হবে তার সংস্থান কিভাবে হবে তারও কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা সমীক্ষা প্রতিবেদনে নেই। এক্ষেত্রে বড় গোঁজামিল দেখছে পরিকল্পনা কমিশন। পিইসি সভায় এসব বিষয় নিয়ে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন করা হয়।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রধান মো. ছায়েদুজ্জামান বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, পিইসি সভায় আয়ের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তারা তাদের মতো করে ব্যাখা দিয়েছেন। এই মুহূর্তে এত ভেতরের বিষয় মনে করতে পারছি না। তবে আমরা বলেছি মোট প্রকল্পের ব্যয় এত বেশি থাকবে না। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় তিনটি কম্পোনেন্টের প্রস্তাব করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। পিইসি সভায় সব পক্ষের আলোচনার পর কম্পোনেন্ট কমানোর বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরকম নানা বিষয়ে সুপারিশ দিয়ে ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) সংশোধনে ফেরত পাঠানো হবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে।
পরিকল্পনা কমিশন বলছে, প্রস্তাবিত ৪ বছর মেয়াদি প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১১৬ কোটি টাকা এডিপি (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) বরাদ্দের প্রয়োজন হবে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এমটিবিএফের (মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামো) তথ্যে থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের ঘাটতি রয়েছে এক হাজার ১২২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। এছাড়া আগামী অর্থবছরেও ঘাটতি থাকবে ৬২৬ কোটি ২১ লাখ টাকা। এ অবস্থায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বাজেট সিলিংয়ের মধ্যে থেকে এই প্রকল্পের অর্থায়ন কিভাবে করা হবে সে বিষয়ে ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্টে কোনো উল্লেখ নেই।
সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদনে এ প্রকল্পের ৩টি কম্পোনেন্ট প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রথম কম্পোনেন্টটি হলো পার্বত্য এলাকার জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য ৭২ হাজার ২৭টি পরিবারকে অনুদান হিসাবে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে বিভিন্ন ধরনের প্রাণী (গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, ভেড়া ইত্যাদি) বিতরণ করা হবে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন তথা দারিদ্র্য বিমোচনের মূল ম্যান্ডেট হলো পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ সমবায়ের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ঋণ মডেলের আওতায় এ ধরনের কাজ করে থাকে। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে অনুদান হিসাবে উপকরণ সহায়তা দিয়ে টেকসই আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কতখানি ফলপ্রসূ তার জন্য ক্ষুদ্রঋণ মডেলের সঙ্গে কোনো তুলনামূলক বিশ্লেষণ সমীক্ষায় উল্লেখ নেই।
প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, পার্বত্য জেলার প্রাণিজ আমিষের উৎপাদন বৃদ্ধি করা। কিন্তু সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদনে পার্বত্য জেলাগুলোর প্রাণিজ আমিষের চাহিদা বা ঘাটতি এবং সরবরাহের তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। স্টাডি রিপোর্টে সারা দেশের দুধ, মাংস এবং ডিমের চাহিদা, উৎপাদন ও প্রাপ্যতার একটি তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। যেখানে দেখা যায়, চাহিদার তুলনায় মাংস ও ডিমের উৎপাদন বেশী রয়েছে এবং দুধের উৎপাদনে কিছুটা ঘাটতি আছে। এ তথ্যের ভিত্তিতে প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় পার্বত্য এলাকার প্রাণিজ আমিষের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য হাঁস, মুরগি, ছাগল, ভেড়া, কবুতর ইত্যাদি বিতরণের যৌক্তিকতা প্রতীয়মান হয় না বলে মনে করে পরিকল্পনা কমিশন।
প্রকল্পের দ্বিতীয় কম্পোনেন্টটি হলো রাঙামাটি জেলায় অবস্থিত পিগ ফার্ম আধুনিকীকরণ। এর জন্য ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৮ কোটি ২৭ লাখ টাকা। রাঙামাটি জেলায় অবস্থিত পিগ ফার্মটি রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের অধীন প্রতিষ্ঠান এবং রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা। তাই রাঙামাটি জেলায় অবস্থিত পিগ ফার্মটি উন্নয়নে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের মাধ্যমে করতে হবে বলে মনে করে পরিকল্পনা কমিশন।
প্রস্তাবিত প্রকল্পের তৃতীয় কম্পোনেন্টটি হলো, বান্দরবান জেলায় একটি ইনস্টিটিউট অব লাইভস্টক সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (আইএলএসটি) স্থাপন করা। এই আইএলএসটি স্থাপনের বিষয়ে প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডিতে প্রস্তাব করা হলেও ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্টের ডিমান্ড অ্যানালাইসিস অংশে বাংলাদেশ লাইভ স্টক ডিপ্লোমা গ্র্যাজুয়েটদের কোন কোন ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ রয়েছে সেটি নেই। এসব ক্ষেত্রে কি পরিমাণ ডিপ্লোমা গ্র্যাজুয়েটের চাহিদা রয়েছে, বর্তমানে প্রতিবছর কি পরিমাণ ডিপ্লোমা গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে ইত্যাদি বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য উল্লেখ নেই। ফলে অসম্পূর্ণ ফিজিবিলিটি স্টাডির ভিত্তিতে প্রকল্পটি তৈরি করা হয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় পিইসি সভায়।