‘নিরাপদ বাংলাদেশ চাই’ স্মরণসভায় বাবা
আবরারের মতো কেউ যেন নির্যাতনের শিকার না হয়
গণরুম, গেস্টরুমের অপসংস্কৃতি যেন ফিরে না আসে : সারজিস আলম * ছাত্রলীগের হামলায় মরে গেলে আবরার, বেঁচে থাকলে হয় শিবির : হাসনাত
ঢাবি প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছাত্রলীগের নির্যাতনে মারা যাওয়া বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ বলেছেন, ‘আমার সন্তানকে রাতভর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে শহিদ করা হয়েছে। আবরারের মতো আর কেউ যেন এ নির্যাতনের শিকার না হয়, কারও পিতামাতার বুক যাতে খালি না হয়-সেজন্য সবাইকে নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।’
সোমবার আবরার ফাহাদের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে শাহবাগে ‘নিরাপদ বাংলাদেশ চাই’ আয়োজিত এক স্মরণসভায় তিনি এসব কথা বলেন। একই সঙ্গে তিনি দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করারও দাবি জানান।
ফাহাদের শাহাদতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সোমবার দিনব্যাপী বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠন নানা কর্মসূচি পালন করে। শাহবাগে ‘নিরাপদ বাংলাদেশ চাই’ প্ল্যাটফরমের আয়োজনে করা হয় ছাত্র-জনতার সংহতি সমাবেশ, ছাত্রদলের ব্যানারে মৌনমিছিল, ছাত্রশিবিরের ব্যানারে আলোচনা সভা ও দোয়া মহফিল, আবরার ফাহাদ স্মৃতি সংসদের ব্যানারে স্মরণসভা।
শাহাবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে দুপুরে নিরাপদ বাংলাদেশ চাই সংহতি সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ। বিশেষ অতিথি ছোট ভাই বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাইয়াজ। সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন ছাত্রসংগঠক ও প্রকাশক আজিজুর রহমান আজাদ, একতার বাংলাদেশের মুখপাত্র ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক তাহমিদ আল মুদ্দাসসির চৌধুরী, বিপ্লবী ছাত্র পরিষদের আহ্বায়ক আবদুল ওয়াহেদ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ, উমামা ফাতেমা, জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসিরুদ্দিন পাটওয়ারী, এবি পার্টির যুগ্ম সদস্যসচিব ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, ছাত্রশিবিরের ঢাবি সভাপতি আবু সাদিক কায়েম, কেন্দ্রীয় সাহিত্য সম্পাদক সিবগাতুল্লাহ, বৈষম্যবিরোধী প্রকৌশলী পরিষদের সমন্বয়ক ইঞ্জিনিয়ার ইমরুল কায়েস পরাগ প্রমুখ। সমাবেশে ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছে। আমরা অনেক শিক্ষক ও প্রক্টর দেখেছি, যারা ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয় দিয়েছেন। ছাত্রলীগের হামলায় কেউ মরে গেলে সে হয় আবরার, আর যে বেঁচে যায়, সে হয় শিবির।
ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা ছাত্রলীগের বিষদাঁত ভেঙে দিয়েছি। তিনি বলেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে বলতে শোনা যায়, তারা আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করে দিয়েছে। আমরা বলতে চাই, গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ যেসব অপরাধ করেছে, ১০০ বছর জেল খাটলেও তাদের শাস্তি পূর্ণ হবে না।
তিনি বলেন, গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও তিনি ভারতে বসে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছেন। আমরা বলতে চাই, এটা কোনো জিহাদি অভ্যুত্থান ছিল না, এটি ছিল জুলুমের বিরুদ্ধে মজলুমের অভ্যুত্থান। ভবিষ্যতে যারা জুলুম কায়েমের চেষ্টা করবে, তাদের এ দেশের ছাত্র-নাগরিক এক হয়ে রুখে দিয়ে জুলুমকে সমূলে উৎখাত করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সভাপতি আবু সাদিক কায়েম বলেন, ১৬ বছরে ছাত্র-জনতার ওপর হওয়া নির্যাতনের বিচার চেয়ে দেশের প্রতিটি থানায় মামলা করুন। ছাত্র-জনতার ওপর হামলাকারী একজন দোসরও যেন আইনের আওতার বাইরে না যায়। দেশের প্রতিটি প্রান্তে ছাত্রশিবির আপনাদের সব ধরনের আইনি সহায়তা দেবে।
আবরার ফাহাদ স্মৃতি সংসদের স্মরণসভা : এদিন পলাশীর মোড়ে আবরার ফাহাদ স্মৃতি সংসদ এক স্মরণসভার আয়োজন করে। এ অনুষ্ঠানে আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেন, ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৫৪ বছর আমাদের যে সংগ্রাম চলছে, আবরার ফাহাদের শহিদ হওয়ার ঘটনা এই সংগ্রামের টার্নিং পয়েন্ট। আমরা শহিদ আবরার ফাহাদকে শতবছর পরও স্মরণ করতে চাই যে, তিনি একজন অসামান্য সাহসী যোদ্ধা ছিলেন। আবরার ফাহাদ এ শতাব্দীর শহিদ তিতুমীর।
বৈষমবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের আগে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় যে গণরুম, গেস্টরুম কালচার ছিল, তা ছিল একেকজন আবরার ফাহাদকে নির্মম নির্যাতনের প্রতীক। আমরা হলে সিট পেয়েছি চতুর্থ বর্ষে ওঠে। অথচ ছাত্রলীগের আদু ভাইয়েরা ৯ থেকে ১০ বছর করে একেকজন সিঙ্গেল রুমে ছিল। যেখানে চারজনের রুমে আমাদের ৪০ জন থাকতে হয়েছে, সেখানে তারা একাই ছিল। গণরুম গেস্টরুমের নির্যাতনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, অতীতের সেই অপশাসন, অপরাজনীতি ও অপসংস্কৃতি যেন ফিরে না আসে আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার বলেন, শহিদ আবরার ফাহাদ আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতীক ও আগ্রাসনবিরোধী প্রতীক। তার হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে দুটি জিনিস স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। এর একটি হলো আওয়ামী লীগের নির্যাতন। অন্যটি হলো ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম।
স্মরণসভা শেষে পলাশী মোড়ে শহিদ আবরার ফাহাদের স্মরণে ৮ ফলকবিশিষ্ট স্তম্ভের পুনর্নির্মাণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন মাহমুদুর রহমানসহ অন্যরা। এ সময় আবরার ফাহাদের বাবা, ছোট ভাইসহ আরও বিশিষ্টজনরা বক্তব্য দেন।
ছাত্রদলের মৌন মিছিল : আবরার ফাহাদের মৃত্যুবার্ষিকীতে মৌন মিছিল করেছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। সোমবার ‘নিরাপদ ও মুক্তবুদ্ধিচর্চার’ গণতান্ত্রিক ক্যাম্পাসের দাবিতে এ মিছিল হয়। শাখা সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস এবং সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপনের নেতৃত্বে মিছিলটি কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার থেকে কার্জন হল, দোয়েল চত্বর হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে।
ঢাবি ছাত্রশিবিরের আলোচনা সভা : আবরার ফাহাদের শাহাদতবার্ষিকীতে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল করে ইসলামী ছাত্রশিবির। সংগঠনের ঢাবি শাখা সভাপতি সাদিক কায়েমের সভাপতিত্বে সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলাম। আলোচনা শেষে শহিদ আবরার ফাহাদসহ জুলাই বিপ্লবের সব শহিদ ও তাদের পরিবারের জন্য দোয়া ও মোনাজাত করা হয়।
আবরার স্মরণে চবি ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের কর্মসূচি : চবি প্রতিনিধি জানান, আবরার ফাহাদের মৃত্যুবার্ষিকীতে দোয়া মাহফিল করেছে চবি ছাত্রশিবির। সোমবার চট্টগ্রামের চকবাজারে চবি শিবিরের সেক্রেটারি মুহাম্মদ ইব্রাহিমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সভাপতি নাহিদুল ইসলাম। প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক আমজাদ হোসেন।
অতিথি ছিলেন চবির সাবেক ব্যবসায় শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক রায়হান উদ্দিন। এদিন আবরার ফাহাদ স্মরণে মৌন মিছিল করে চবি ছাত্রদল। মিছিলটি জিরো পয়েন্ট থেকে শুরু হয়ে শহিদ মিনারে গিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন চবি ছাত্রদলের সভাপতি আলাউদ্দিন মহসিন এবং সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমান। বক্তব্য দেন সিনিয়র সহসভাপতি মামুনুর রশিদ, সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক ইয়াছিন ও সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন হৃদয়।
খুনিদের দ্রুত ফাঁসি কার্যকর চান আবরারের মা : কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানান, খুনিদের দ্রুত ফাঁসি কার্যকর করার দাবি করেছেন আবরার ফাহাদের মা রোকেয়া খাতুন। সোমবার কুষ্টিয়ায় আবরারের বাড়িতে গে?লে তিনি এ প্রতিবেদকের মাধ্যমে এ দাবি জানান। রোকেয়া খাতুন ব?লেন, হত্যা মামলার রায় হয়েছে। আসামিদের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। কেউ কেউ পলাতক রয়েছে। সব আসামির দ্রুত ফাঁসি কার্যকর করা হোক।
আবরারের মৃত্যুবার্ষিকীতে কুষ্টিয়ায় তেমন কোনো কর্মসূচি না থাকলেও কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসাবে মৌন মিছিল ও স্মরণসভা করেছে কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রদল। সোমবার বেলা ১১টায় কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে এ মৌন মিছিল ও স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। সকালে গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কয়ায় তার কবরস্থানে দোয়া করেন মা রোকেয়া খাতুন।
আপিল দ্রুত শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে-অ্যাটর্নি জেনারেল : বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের ডেথ রেফারেন্স এবং হাইকোর্টে আসামিদের করা আপিলের দ্রুত শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সোমবার অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের এ কথা জানান। তিনি বলেন, ‘আপিলের পেপার বুক প্রস্তুত করে দ্রুত হাইকোর্টে শুনানির জন্য রাষ্ট্রপক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অবকাশকালীন ছুটি শেষেই মামলাটির আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে।
আবরার ফাহাদ বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয়বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। বুয়েটের শেরেবাংলা হলের সিঁড়ি থেকে ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যাপক ছাত্র বিক্ষোভ হয়। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে সমাজের নানা শ্রেণিপেশার মানুষও সোচ্চার হয়। নির্মম এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ পরদিন চকবাজার থানায় মামলা করেন। সে মামলার বিচার শেষে ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড ও পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ঢাকার একটি আদালত। মামলাটি এখন হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স এবং আসামিদের করা আপিল শুনানির জন্য রয়েছে।
আবরার হত্যা কেন্দ্র করে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আসামিদের সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ৬ অক্টোবর আবরার ফাহাদের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল। বিভিন্ন সংগঠন দিবসটি পালনে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে।