Logo
Logo
×

শেষ পাতা

একান্ত সাক্ষাৎকারে ডিএসইর চেয়ারম্যান

মূল চ্যালেঞ্জ পুঁজিবাজারে আস্থা ফেরানো

মনির হোসেন

মনির হোসেন

প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মূল চ্যালেঞ্জ পুঁজিবাজারে আস্থা ফেরানো

দেশের শিল্পায়নে দীর্ঘমেয়াদি পুঁজির জোগান দেয় শেয়ারবাজার। কিন্তু বর্তমানে এখানে মূল সমস্যা আস্থার সংকট। গত কয়েক বছরে নানা কারণেই এই আস্থার ঘাটতি তৈরি হয়েছে। আবার এই শেয়ারবাজারে অনেক বড় প্ল্যাটফর্ম হলো ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। এখানে নানা ধরনের অংশীজন আছেন। তাদের চিন্তা ও ধারণা সব সময় এক রকম নয়। ফলে বাজারে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। তবে এই মুহূর্তে মূল চ্যালেঞ্জ বা দায়িত্ব হলো বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনা। এক্ষেত্রে শুরুতেই আমরা বাজারে একটা ইতিবাচক বার্তা দিতে চাই। যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে ডিএসইর নতুন চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনির হোসেন।

যুগান্তর : খুব অগোছাল এবং বিশৃঙ্খল সময়ে ডিএসইর দায়িত্ব নিয়েছেন। কোন বিষয়টিকে সবচেয়ে অগ্রাধিকার দিতে চান।

মমিনুল ইসলাম : আপনি একেবারে সঠিকভাবে শব্দচয়ন করেছেন। অগোছাল এবং বিশৃঙ্খল সময়। তবে যখন কোনো একটা পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় যায়, সেখান থেকে আমূল পরিবর্তন করার সুযোগ থাকে। আমার সেই অভিজ্ঞতা আছে। এর আগে আমি দেশের একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ‘আইপিডিসি’তে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। যখন সেখানে যোগদান করেছিলাম, তখন প্রতিষ্ঠানটি খুব খারাপ অবস্থায় ছিল। খেলাপি ঋণ ছিল ৫০ শতাংশের বেশি। তারল্য সংকট ছাড়াও টিমের লোকজনের মনোবল দুর্বল ছিল। কিন্তু আমাদের সম্মিলিত চেষ্টায় সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। কোম্পানিটি এখন দেশের প্রথমসারির আর্থিক প্রতিষ্ঠান। তবে আইপিডিসির তুলনায় ডিএসই অনেক বড়। এখানে নানা ধরনের অংশীজন আছেন। তাদের চিন্তা ও ধারণা সব সময় এক রকম নয়। ফলে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। তবে বৃহস্পতিবার প্রথম বোর্ড মিটিং করেছি। সেখানে শুভ সূচনা হয়েছে। বাইরের কোনো ইঙ্গিতে নয়, পর্ষদ সদস্যদের সরাসরি ভোটে চেয়ারম্যান হয়েছে। এছাড়াও বাজারের অন্যতম এবং স্টক এক্সচেঞ্জের প্রাথমিক স্টেকহোল্ডার ব্রোকারেজ হাউজ। তাদের সঙ্গে আমাদের ইনফরমাল যোগাযোগ হয়েছে। তাদের অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ) আমাদের একই বিল্ডিংয়ে। সৌজন্য দাওয়াত দিয়ে আমাদের তাদের অফিসটা দেখিয়েছেন। এই সপ্তাহের মধ্যে আমরা তাদের সঙ্গে একটা বৈঠক করব। অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গেও দ্রুতই বৈঠক করব। আমাদের মূল কাজ হবে বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনা। এক্ষেত্রে শুরুতেই বাজারে একটা ইতিবাচক বার্তা দিতে চাই।

যুগান্তর : বাজারের অন্যতম সমস্যা ভালো কোম্পানি হাতেগোনা কয়েকটি। এক্ষেত্রে ভালো শেয়ারের সরবরাহ বাড়ানোর বিষয়ে কী ভাবছেন?

মমিনুল ইসলাম : এটি সত্য, বাজারে ভালো কোম্পানির সংখ্যা কম। কিন্তু ভালো কোম্পানি বাজারে আসতে কেন অনাগ্রহী সেটি ভাবতে হবে। তাদের আগ্রহী করার জন্য যেসব কাজ করতে হবে, সে ব্যাপারে আমরা উদ্যোগ নেব। এক্ষেত্রে রেগুলেশন ও ভ্যালুয়েশন পরিবর্তন এবং সময় বিবেচনায় রেখে বিশ্বের অন্যান্য দেশে কী হয়, সেভাবে আমরা কাজ করব। বিশেষ করে আমাদের আশপাশের দেশে ভালো কোম্পানি আসছে, আমাদের এখানে কেন আসছে না। বর্তমানে ভারতে বাজারমূলধন ওই দেশের জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) শতভাগের বেশি। কিন্তু বাংলাদেশে ৭-৮ শতাংশ। আগামী ৩ বছরে এটি জিডিপির ১৫ শতাংশে নিতে চাই। পরে ৫ বছরে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশে যেতে পারে, এটি আমাদের লক্ষ্য।

যুগান্তর : সাম্প্রতিক সময়ে সংস্কার শব্দটি বেশ জনপ্রিয় ও জোরালোভাবে আসছে। ডিএসইর প্রেক্ষাপটে সংস্কার নিয়ে ভাবনা কী?

মমিনুল ইসলাম : বর্তমানে বাজার অতি সংবেদনশীল হয়ে আছে। সেখানে সবাই সংস্কার চায়। অর্থাৎ দুর্নীতিমুক্ত, সক্রিয় ও প্রাণবন্ত পুঁজিবাজার প্রত্যাশা। কিন্তু সংস্কারের একটা পেইন (বেদনা) আছে। আবার যারা সংস্কার চান, তারা এই পেইন নিতে চান না। উদাহরণস্বরূপ বাজারে স্বাভাবিক আচরণের বাইরে, কারও হস্তক্ষেপে, ইশরায়, ইন্ধনে বা অন্য কোনো কারণে সূচক যখন উঠানামা করে, তখন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা অধৈর্য হয়ে পড়েন। ফলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের প্রতি বিনীত অনুরোধ, আপনারা ধৈর্য ধরবেন। দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের জন্য আমাদের সময় দেবেন। আমরাও সংস্কার নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ সবার সঙ্গে কথা বলব। কোন সংস্কার আগে করব, কোনটা পরে করব সেটি ঠিক করা হবে। চেষ্টা করব যতদূর সম্ভব, ন্যূনতম নেতিবাচক প্রভাব রেখে সংস্কার করতে। অর্থাৎ সংস্কারের জন্য বিনিয়োগকারীদের যত কম পেইন নিতে হয়, সেটি নিশ্চিত করার চেষ্টা করব। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো পর্ষদ আইনকানুন কৌশল ঠিক করে। কিন্তু ডিএসইর অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী না হলে বাজার ইতিবাচক হবে না। এই মুহূর্তে ডিএসইতে তিনটি বড় পদ শূন্য। এর মধ্যে রয়েছে-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) এবং চিফ টেকনোলজি অফিসার (সিটিও)। আমরা নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছি। সেখানে যোগ্য লোক খুঁজে পাওয়া এবং নিয়োগ দেওয়া অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের কাজ।

যুগান্তর : বিভিন্ন সময়ে আমরা স্টক এক্সচেঞ্জের সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) দূরত্ব দেখেছি। স্টক এক্সচেঞ্জের অভিযোগ, আইনে তাদের যে ক্ষমতা দেওয়া আছে, সেটি তারা ব্যবহার করতে পারছে না। অর্থাৎ স্টক এক্সচেঞ্জ নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?

মমিনুল ইসলাম : আপনি সঠিকভাবে এই জায়গা ধরেছেন। স্টক এক্সচেঞ্জ যে উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি হয়, তা হলো স্বশাসিত ও স্বনিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান। আর মৌলিক আইনকানুন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন নির্ধারণ করে দেয়। স্টক এক্সচেঞ্জে কোনো আইনের ব্যত্যয় বা নন কমপ্লায়েন্স হলেই শুধু সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন হস্তক্ষেপ করে। কিন্তু স্টক এক্সচেঞ্জ অভিযোগ করে আসছে, বিএসইসি আমাদের ওপর এমন কিছু চাপিয়ে দিচ্ছে, যা তাদের ইখতিয়ারভুক্ত নয়। আমাদের অধিকার আছে, আমরা এটা নির্ধারণ করব। আবার বিএসইসি বলছে, স্টক এক্সচেঞ্জ তাদের কাজ করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে আমাদের হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। এক্ষেত্রে দুপক্ষের কিছু যুক্তি আছে। এ কারণেই আমি বলছি স্টক এক্সচেঞ্জ শক্তিশালী হলে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন থাকবে না। বিএসইসির চেয়ারম্যান আমাকে বলেছেন, তারা স্টক এক্সচেঞ্জের কাজে হস্তক্ষেপ করবেন না।

যুগান্তর : ডিমিউচুয়ালাইজেশন শর্ত অনুসারে স্টক এক্সচেঞ্জের স্বতন্ত্র পরিচালকরা তাদের ভূমিকা রাখতে পারছেন না। কেউ কেউ আবার অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়েছেন। আবার নির্বাচিত পরিচালকদের সঙ্গেও দূরত্ব রয়েছে। এ ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন কী?

মমিনুল ইসলাম : স্বতন্ত্র পরিচালকদের নন কমপ্লায়েন্স যাতে না হয়, সে ব্যাপারে আমরা ইতোমধ্যে উদ্যোগ নিয়েছি। প্রথম বোর্ড মিটিংয়ে আমরা বলেছি, যাদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ আছে, তা প্রতি মাসে কোম্পানি সচিবালয়ে জানাতে হবে। এটি আমাদের আইনেই আছে। কিন্তু এর আগে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটিকে সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয়নি। আমরা সঠিকভাবে এই নিয়ম অনুসরণ করবা। এছাড়াও স্বতন্ত্র পরিচালকদের বাজার থেকে অনৈতিকভাবে টাকা বানানোর সুযোগ নেই। এটি আমরা নজরদারিতে রাখব। দ্বিতীয় বিষয় হলো, নির্বাচিত ও স্বতন্ত্র পরিচালকরা শুধু নিজের স্বার্থে কাজ করলে সেখানে স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। আমাদের নিজেদের স্বার্থের বিষয় নেই। আমরা বাজারের স্বার্থে কাজ করব। একটি উদাহরণ দিলে বুঝতে পারবেন। ডিএসইর পর্ষদ থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বোর্ডে সদস্য দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে সিডিবিএলের পর্ষদে সব সময় ডিএসইর চেয়ারম্যান প্রতিনিধিত্ব করতেন। কিন্তু এ বছর আমরা নির্বাচিত পরিচালক শাকিল রিজভীকে মনোনয়ন দিয়েছি। কারণ তিনি অনেক দিন থেকে বাজারে রয়েছেন। নিয়মকানুন সম্পর্কে অভিজ্ঞ। তাই সবার সঙ্গে আলোচনা করে এটি করা হয়েছে। এভাবে বাজারের স্বার্থে আমরা কাজ করে যাব।

যুগান্তর : বাজারে অনেক দিনের একটি প্রবণতা আছে, সূচক কমলেই বিনিয়োগকারীরা স্টক এক্সচেঞ্জ কিংবা বিএসইসিকে দায়ী করে মিছিল দেয়। এর ফলে নীতিনির্ধারকরা এক ধরনের চাপে পড়ে অবৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত নেন। বিনিয়োগকারীদের এই আচরণের ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন কী?

মমিনুল ইসলাম : আমাদের দেশে বিনিয়োগের ভালো জায়গা নেই। আর্থিক মধ্যস্থতাকারীদের মধ্যেও দায়িত্বের দুর্বলতা আছে। তারা অনেক সময় চটকদার প্রলোভনে সাধারণ বিনিয়োকারীদের আগ্রহী করে তোলেন। তাদের হঠাৎ বড় লোক হয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখানো হয়। এটি বাজার এবং বিনিয়োগকারী কারও জন্য ভালো নয়। কিন্তু গুটিকয়েক মানুষের লাভ হয়। ফলে সবার আগে শেয়ারবাজার বিনিয়োগকারীদের হঠাৎ বড় লোক হওয়ার মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। দ্বিতীয় বিষয় হলো, শেয়ারবাজারে উত্থান-পতন থাকবে। এটা নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে বিচলিত হলে চলবে না। তারা বিচলিত হয়ে বা বিনিয়োগকারীদের চাপে ভয় পেয়ে কিছু কৃত্রিম কাজ করেন। যেমন কাউকে শেয়ার বিক্রি বন্ধ করা কিংবা কিনতে বলা হয়। আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, এসব কাজ দীর্ঘমেয়াদে বাজারের জন্য ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনে।

যুগান্তর : চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি বাজারে কী সম্ভাবনা দেখছেন?

মমিনুল ইসলাম : যে কোনো দেশে পুঁজিবাজার অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। মধ্যম আয়ের দেশ হিসাবে আমরা নিজেদের পরিচিত করতে চাইলে সক্রিয় পুঁজিবাজার জরুরি। বর্তমানে দেশের শিল্পায়নের ৯০ শতাংশের বেশি পুঁজির জোগান দেয় ব্যাংক। বাকিটা পুঁজিবাজার থেকে আসে। কিন্তু বড় প্রতিষ্ঠান শুরু থেকেই শেয়ারবাজার থেকে টাকা নেয় না। এছাড়া বন্ড মার্কেট ও মিউচুয়াল ফান্ডসহ ভালোভাবে কাজ করছে না। বিশ্বেব্যাপী মিউচুয়াল ফান্ড অনেক জনপ্রিয় হলেও বাংলাদেশে কিছু মানুষের অযাচিত হস্তক্ষেপে আইনকানুনে পরিবর্তন আনা হয়েছে। ফলে এ তিনটি জায়গা ঠিক করতে পারলে বাজারের জন্য বিশাল সম্ভাবনা তৈরি হবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম