ট্রেজারি ভবন নির্মাণে ১৫ খাতে বাড়তি ব্যয়
বিলাসী অবকাঠামো প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন
হামিদ-উজ-জামান
প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিগত সরকারের নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ও বাড়তি ব্যয়ের খেসারত দিচ্ছে দেশের মানুষ। দেশে চলছে অর্থনৈতিক সংকট। এ সময়েও বিলাসী প্রকল্প প্রস্তাব কীভাবে তৈরি হয় তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রকল্পটির নাম ‘পাবনা জেলায় ট্রেজারি ভবন নির্মাণ।’ এটি বাস্তবায়নে ১৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো এ প্রকল্প প্রস্তাবে প্রায় ১৫টি খাতে বাড়তি ও অযৌক্তিক ব্যয় ধরা হয়েছে বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশন।
আগামী ১৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি) সভা। ওই সভায় প্রকল্প ব্যয় সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হবে বলে জানা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যয় কমালেই হবে না, বর্তমান পরিস্থিতিতে এ রকম বিলাসী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প বাদ দেওয়া প্রয়োজন। সূত্র জানায়, এই ব্যয় বাড়ানোর কারণ সম্পর্কে পিইসি সভায়ও প্রশ্ন তোলা হবে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ও বর্তমান সরকারের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য ড. জাহিদ হোসেন বুধবার যুগান্তরকে বলেন, এ রকম বেশি ব্যয় প্রস্তাব যারা করেন তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ নিয়ে কোনো বিধিবিধান নেই। যারা এমন কাজের সঙ্গে যুক্ত তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। দেশে চরম অর্থনৈতিক সংকট চলছে উল্লেখ করে তিনি প্রশ্ন তোলেন-এই সময়ে এমন বিলাসী প্রকল্প নেওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত? এখন এমন ধরনের প্রকল্প গ্রহণের সময় নয়। শুধু ব্যয় কমালেই হবে না, বরং প্রকল্পটি বাদ দেওয়া উচিত। প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণের পেছনেও অনেক সময় অপচয় হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে দোতলা ফাউন্ডেশনবিশিষ্ট দোতলা ট্রেজারি ভবন নির্মাণে ১ হাজার ৮৫৮ বর্গমিটারের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ কোটি ৭৯ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারের খরচ পড়বে ৪৭ হাজার ৩৩৩ টাকা। কিন্তু গণপূর্ত অধিদপ্তরের ২০২২ সালের রেট শিডিউল অনুযায়ী বর্গমিটারপ্রতি ব্যয় হওয়ার কথা ২৩ হাজার ৮৫ টাকা।
প্রস্তাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৪০ কেভিএ জেনারেটর অঙ্গের ব্যয় ২৮ লাখ ২৫ হাজার টাকা ধরা হয়। অথচ গণপূর্তের রেট শিডিউলে আছে ১৭ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। প্রায় দ্বিগুণ ব্যয় প্রস্তাব নিয়ে পিইসি সভায় প্রশ্নের মুখে পড়তে যাচ্ছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। ভবনের জন্য ১৬০০ কেজি লিফট (২ স্টেপ, কারগো) একটি করে দাম ধরা হয়েছে ১ কোটি ১৯ লাখ ৫৩ হাজার টাকা। রেট শিডিউলে রয়েছে (৩ স্টেপ, কারগো) ১ কোটি ২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। অথচ ২ স্টেপ কারগো হলেও এই লিফটের দাম বেশি প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া সাবস্টেশন ইকুইপমেন্ট ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা। অথচ গণপূর্তের রেট শিডিউলে ১ লাখ ৮৬ হাজার উল্লেখ রয়েছে।
বাড়তি ব্যয়ের ক্ষেত্রে আরও আছে অভ্যস্তরীণ আরসিসি রাস্তা ১ হাজার ৩ দশমিক ৩৪ বর্গমিটারের ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৬২ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে বর্গমিটার প্রতি ব্যয় হবে ৬ হাজার ২২৮ টাকা। অথচ গণপূর্তের রেট শিডিউলে প্রতিবর্গমিটারের ব্যয় ধরা আছে ২ হাজার ৮৮৬ টাকা করে। সীমানা প্রাচীর নির্মাণে ১৯২ দশমিক ৬৮ মিটারের ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৮৩ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। এতে মিটারপ্রতি খরচ হবে ২৮ হাজার ৬৬৩ টাকা। কিন্তু গণপূর্তের রেট শিডিউলে আছে ২৩ হাজার ১২৯ টাকা। এছাড়া কম্পাউন্ড ড্রেন নির্মাণে ১৪০ দশমিক ২২ মিটারের ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এতে প্রতি বর্গমিটারের খরচ পড়বে ৬ হাজার ২৪০ টাকা। কিন্তু গণপূর্তের রেট শিডিউলে উল্লেখ আছে ৩ হাজার ১৯৬ টাকা।
এই প্রকল্পে কিছু খাতে ব্যয় প্রস্তাব যৌক্তিকভাবে দেওয়া হয়নি বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশন। সেগুলো হলো-ভূগর্ভস্থ জলাধার নিমাণে ৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা, সোলার সিস্টেমের জন্য ৮ লাখ ৪৫ হাজার টাকা এবং গভীর নলকূপের জন্য ১৫ লাখ টাকা। এছাড়া পাম্প হাউজ নির্মাণে ৮ লাখ ৭৮ হাজার টাকা, সার্জ প্রটেকশন সিস্টেমে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, পাম্প মোটর সেট ২ লাখ ৭২ হাজার টাকা এবং কম্পাউন্ড সিকিউরিটি লাইটের জন্য ৩ লাখ ১১ হাজার টাকা। এছাড়া গার্ড শেড ও গেট তৈরিতে ৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, স্টিল র্যাকের জন্য ৪৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা এবং ভবন নির্মাণসংক্রান্ত সামগ্রীর জন্য ১২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। পরিকল্পনা কমিশন থেকে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের পিইসি সভায় জানিয়ে দেওয়া হবে এসব অঙ্গের ব্যয় কমাতে হবে।